শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ!
১২ মার্চ ২০১৮ইউনিসেফ-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর ৬২ হাজার নবজাতকের মৃত্যু হয়৷ এরা মারা যায় জন্ম থেকে ২৮ দিনের মধ্যে৷ আর জন্মের পর এক দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ ৩১ হাজার নবজাতক৷ তবে সার্বিক বিচারে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে৷ ইউনিসেফ-এর ‘লেভেলস অ্যান্ড ট্রেন্ডস ইন চাইল্ড মর্টালিটি রিপোর্ট-২০১৭' অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার শতকরা ৭৩ ভাগ কমেছে৷
জন্মের পর ৭ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ১৯ শতাংশ নবজাতক৷ নবজাতকের মোট মৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটছে বাড়িতে৷ পাঁচ বছরের কম বয়সি যে শিশুদের মৃত্যু হয়, তাদের ৬০ শতাংশই নবজাতক৷
প্রতিবেদনে ১৯৯০ সালের সঙ্গে ২০১৬ সালের তুলনা করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে মারা যেতো গড়ে ১৪৪ জন৷ সেটি কমে ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে গড়ে ৩৪ জনে৷ এর ৪৬ শতাংশ মারা গেছে জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে৷
নবজাতক মৃত্যুর ৮৮ শতাংশই ঘটছে সংক্রমণ, শ্বাসজনিত সমস্যা ও স্বল্প ওজন নিয়ে অপরিণত জন্মসংক্রান্ত কারণে৷ আর এর একটি বড় কারণ কিশোরী মাতৃত্ব৷ যেসব নবজাতক মারা যায় তাদের বড় একটি অংশ ২ হাজার ৫০০ গ্রাম বা তারও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়৷
অর্থনেতিক অসচ্ছলতা এবং সঠিক জ্ঞানের অভাবে অর্ধেকেরও বেশি গর্ভবতী মা এখনো অপুষ্টিতে ভোগেন৷ মা অপুষ্টিতে ভুগলে গর্ভের শিশুও অপুষ্টিতে ভোগে৷ গর্ভবতী মায়েদের একটি অংশ ডায়াবেটিস রোগে ভোগেন, তাঁরা নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন৷ ১৮ বছরের আগেই তাঁদের বিয়ে এবং গর্ভধারণ হয়৷
কৈশোরে গর্ভধারণ এবং স্বল্প ওজনের কারণে শতকরা ৪৫ ভাগ নবজাতকের মৃত্যু হয়৷ ইউনিসেফের নিউবর্ন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ মামণি এইচএসএস প্রজেক্ট'-এর একজন কর্মকর্তা জানান, প্রধানত তিনটি কারণে শতকরা ৭০ ভাগ নবজাতকের মৃত্যু হয়৷ এরমধ্যে অপরিণত হওয়ার কারণে ৪৫ ভাগ এবং বাকি ২৫ ভাগ মারা যায় শ্বাসকষ্ট এবং ইনফেকশনের কারণে৷ তাছাড়া যত শিশু জন্মের পর মারা যায়, তার সমপরিমাণ শিশু গর্ভেই মারা যায়৷
নবজাতকের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে৷ যুক্তরাজ্যভিত্তিক মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানচেট'-এর ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৩,১০০ নবজাতকের মৃত অবস্থায় জন্ম হয়৷ ২০০০ সালে এই সংখ্যা ছিল ১,৬০,৩০০৷ হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রওশন আরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাল্যবিবাহ নবজাতক মৃত্যুর অন্যতম কারণ৷ কিশোরী মায়ের নবজাতকের মৃত্যু ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ তাদের সন্তান অপুষ্টির শিকার হয়, ওজন কম হয়, ফলে তারা মারা যায়৷ এ ধরনের মায়েরাই ঠিকমতো পুষ্টি পায় না৷ ফলে তার গর্ভের সন্তানও পুষ্টি পায় না৷ ফলে তারা দুই কেজি বা তারও কম ওজনের বাচ্চা জন্ম দেয়৷''
তাঁর কথায়, ‘‘নবজাতকের মৃত্যুর হার গ্রামে বেশি৷ শহরে কিন্তু অত নয়৷ এখনো গ্রামে প্রশিক্ষিত ধাত্রী দিয়ে সন্তান প্রসবের কালচার তেমন গড়ে ওঠেনি৷ আর সন্তান প্রসবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় নেয়া হয়৷ ফলে নবজাতক মৃত অবস্থায় জন্ম নেয়৷ বাড়িতে প্রসবের পর ৫৫ শতাংশ মাতৃমৃত্যু এবং ৭৩ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, যদিও বর্তমানে তিন হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷''
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রসবকালীন অপরিচ্ছন্নতা ও নাভির নাড়ির যত্নের অভাবে মেটারনাল অ্যান্ড নিওনেটাল টিটেনাস (এমএনটি) প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়৷ এতে মৃত্যুর হারও খুব বেশি৷ বিশেষ করে এ সময়ই টিটেনাসের বিস্তার ঘটে৷
২০০৭ সালে শতকরা ২৩ জন নবজাতকের জন্মের সময় প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সহায়তা নেয়া হতো৷ এখন তা হয়েছে শতকরা ৪২ ভাগ৷ কিন্তু এটা সন্তোষজনক নয়৷ এর ফলে নবজাতকের মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না৷ ডা. রওশন আরা বলেন, ‘‘লেবার পেইন শুরু হওয়ার ছয় ঘণ্টার মধ্যেই সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে৷ কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সেই বাচ্চা প্রসবে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা সময় নেয়া হয়, যার ফলে মৃত অবস্থায় নবজাতকের জন্ম হয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘নবজাতকের মৃত্যু কমাতে হলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে৷ আমরা যতই বলি না কেন বাল্যবিবাহ এখনো সেই অর্থে কমিয়ে আনা যায়নি৷ বাড়িতে সন্তান প্রসব না করে হাসপাতাল বা কমিউনিটি ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে৷ তাছাড়া বাড়িতে সন্তান প্রসব হলে তা অবশ্যই প্রশিক্ষিত ধাত্রীর মাধমে করাতে হবে৷ এখনো শতকরা ৬২ ভাগ ডেলিভারি হয় সাধারণ দাই দিয়ে৷''
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃমৃত্যু ও নবজাতক বিভাগের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম সরকার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘জন্মের পর শিশুর নাড়ি কাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এটা ঠিকমতো না হলে ইনফেকশন হয়, যা নবজাতকের মৃত্যুর একটা বড় কারণ৷ আমরা এজন্য আমবিলিক্যাল কর্ড ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছি৷ কিন্তু এখনো আমরা ৩০ ভাগের বেশি রিস্ক-ফ্রি কর্ড ব্যবহারের আওতায় আনতে পারিনি৷ ফলে ৭০ ভাগ ঝুঁকির মুখে থেকে যাচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তিনটি প্রধান কারণে নবজাতকের মৃত্যু হয়৷ এটা সংশ্লিষ্ট সবার জানা৷ আমরা এই কারণগুলো দূর করার চেষ্টা করছি৷''
বাংলাদেশে শিশুদের জন্মের পরে যে টিকাদান কর্মসূচি আছে তা শিশু মৃত্যু কমাতে বড় একটি সাফল্য নিয়ে এসেছে৷ তাই নবজাতক বাদ দিলে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুমৃত্যু কমাতে বাংলাদেশ সফল হচ্ছে৷ নবজাতকের মৃত্যুর হার ধীরে হলেও কমছে বলে দাবি করে ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, ‘‘আমরা আশা করি ২০২১ সালে এসডিজি-র লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবো৷''
বিশ্বে পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের মৃত্যুর হার ক্রমেই কমে আসছে৷ তবে বাড়ছে নবজাতকের মৃত্যুর হার৷ বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার নবজাতক মারা যাচ্ছে৷ নবজাতক মৃত্যুর প্রবণতা ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে৷ বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি শিশু ২৮ দিন বয়সের মধ্যে মারা যাবে বলে ইউনিসেফ-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে৷
নবজাতকের মৃত্যু রোধে সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে? মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷