নাগরিকপঞ্জি নিয়ে রাজনীতি, অথৈ জলে মমতা
৮ আগস্ট ২০১৮‘গৃহযুদ্ধ' ও ‘রক্তগঙ্গা' পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচ্চারিত এই দু'টি শব্দ কার্যত ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে৷ ভারতের অসম রাজ্যে অনুপ্রবেশ-সমস্যা আজকের নয়৷ সেখানকার সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-যুবর দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল আজকের নাগরিকপঞ্জি৷ অথচ সাত-পাঁচ না ভেবে শুধুমাত্র বাঙালি আবেগে ভর করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মমতা৷ গত ৩০ জুলাইঅসমে নারগিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া তালিকাপ্রকাশিত হয়েছে৷ তালিকায় ৪০ লক্ষের বেশি মানুষের নাম নেই৷ পরদিনই দিল্লিতে প্রকাশ্যে মমতা বলেছেন, ‘‘এটা অন্যায়৷ এত মানুষের নাম বাদ পড়লে দেশে গৃহযুদ্ধ হবে৷ রক্তগঙ্গা বইবে৷''
ব্যাস, শুরু হয়ে গেছে রাজনীতি৷ অসম ও নতুন দিল্লির শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির হাতে যেন ‘হাতিয়ার' তুলে দিয়েছেন তিনি৷ মূল ইস্যু ছিল অনুপ্রবেশ৷ অথচ মমতার মমতাময়ী স্পর্শে ক্রমে তা এসে দাঁড়িয়েছে হিন্দু-মুসলিম এবং বাঙালি-অবাঙালিতে৷
আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল সরাসরি নাগরিকপঞ্জির বিরোধিতা করেনি৷ করার কথাও নয়৷ কারণ তারা শাসক নয়৷ বিচার ব্যবস্থার নির্দেশে তৈরি হচ্ছে নাগরিকপঞ্জি৷ তবে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাড়াহুড়ো করে ভুল পথে পা-বাড়ালেন?
অসমিয়া দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিক আশীষ গুপ্ত ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ১৯৮৫ সালে ভারত সরকারের চুক্তি অনুযায়ী এনআরসি তৈরি হচ্ছে৷ যে তালিকা প্রকাশ হয়েছে, তা মোটেই চূড়ান্ত নয়৷ তা সত্ত্বেও একটা রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই ৪০ লক্ষ মানুষকেই ‘অনুপ্রবেশকারী' আখ্যা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে৷ সেখানকার মানুষকে কার্যত অপমান করা হচ্ছে৷ জনসমক্ষে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে৷ অথচ সুপ্রিম কোর্টও এই তালিকাকে চূড়ান্ত বলেনি৷'' তালিকা থেকে যাঁরা বাদ পড়বেন তাঁরা ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানাতে পারবেন৷ তাই আশীষ মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান ঠিক নয়৷ চটজলদি মন্তব্য করে ফেলেছেন উনি৷ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া মানুষকে সমস্যায় ফেলে দিতে পারে৷ কারণ এখনও পর্যন্ত কোথাও বাঙালি আক্রান্ত হয়নি৷ ধর্ম ও ভাষা দিয়ে নাগরিকত্বের বিচার হয় না৷ তাই হিংসাত্মক প্রচার করা ঠিক নয়৷ যারা জাত-ধর্মের ভেগাভেদ করে ভোটবাক্স মজবুত করতে চাইছেন, মমতার এই অবস্থান আসলে তাদের ফাঁদে পা-দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়৷''
বিশ্বের ইতিহাসে কোনো দেশে একসঙ্গে এত মানুষকে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করা হয়নি৷ আবার কোনো দেশই সীমান্তের অনুপ্রবেশকারীদের সাদর আমন্ত্রণ করে মাথায় করে রাখেনি৷ স্বভাবতই ভারতেও এ নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক চলছে৷ এই পঞ্জির ত্রুটি, বিচ্যুতি দেখার দায়িত্ব আদালতের৷ নাগরিকপঞ্জির দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই শীর্ষ, কর্তাকে আদালতে ডেকে পাঠিয়ে কার্যত তুলোধোনা করে ছেড়েছেন বিচারপতিরা৷ একদিন আগের ঘটনা৷ তাছড়া আদালতের নির্দেশ, ‘এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না৷'
তা সত্ত্বেও গৃহযুদ্ধ, রক্তগঙ্গা কেন?
পশ্চিমবঙ্গের নেত্রী মমতাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, মমতা আসলে মমতাই৷ নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া অসহায় মানুষদের নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ যেমন তিনি ‘পরিচয়' কবিতায় লিখেছেন, ‘‘তোমার পরিচয় কী? তোমার পদবী কী? কেন্দ্রের এক আঁচড়ে নিজভূমে পরবাসী ৪০ লক্ষ মানুষ৷''
অন্যদিকে, এটাও সত্যি যে, তালিকা থেকে নাম বাদ পড়া মানুষের বেশিরভাগই মুসলিম৷ কিন্তু একটা বড় অংশের হিন্দুরাও তালিকার বাইরে রয়ে গেছে৷ এঁরা কেউই প্রভাবশালী নন৷ প্রায় সকলেই দরিদ্র এবং সমাজিক ভাবে অবহেলিত৷ ত্রুটিপূর্ণ তালিকা৷ বহু জনপ্রতিনিধি, গুণী ও স্বনামধন্য মানুষের নাম বাদ পড়েছে৷ সরকার মেনে নিয়েছে সেকথা৷ তাই চলছে সংশোধনের কাজ৷ তাহলে এখন তালিকা বহির্ভূতদের ভবিষ্যত কী?
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা ভারতের সংসদ সদস্য সুগত বসু বললেন, ‘‘১২০ বছর আগে পূর্ব বাংলার ময়মনসিংহ জেলায় জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় বহু মানুষ (কৃষক) ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় পাড়ি দিয়েছিল৷ তাঁরা অনেক পরিশ্রম করে সেখানে পতিত জমিকে উর্বর করে তুলেছিলেন৷ তাঁদেরই উত্তরাধিকারীরা সেখানে বসবাস করছেন৷ এটা উনিশ শতক ও বিশ শতকের ইতিহাস৷ একে অস্বীকার করলে চলবে না৷ এখন এই যে ৪০ লক্ষ মানুষ রেজিস্টার থেকে বাদ পড়েছেন, তাতে অবশ্যই ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে৷ তাঁরা জানেন না তাঁদের ভবিষ্যত কী৷ এরকম অবস্থা কখনওই গ্রহণযোগ্য নয়৷ আজকের পৃথিবীতে নাগরিকত্বের ভাষা বা অভিভাষীদের কথা তুলে ধর্ম বা ভাষা – এই সবের ভিত্তিতে অনেক অন্যায়, অবিচার করা হয়৷''
সুগত বসুর মতে, অসমে যেটা হয়েছে সেটা খুবই দুঃখের৷ তিনি বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য বিকৃত করে চালানো হচ্ছে৷ তিনি গৃহযুদ্ধ ও রক্তগঙ্গার কথা বলে বোঝাতে চেয়েছেন, অশান্তি না ছড়িয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাধান করতে হবে৷ অসমে যেসব মানুষ ভীত হয়ে আছেন, তাঁদের একটা বার্তা দেওয়ার জন্যই তিনি এক প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন৷ তাঁদের বোঝাতে যে, এ দেশে এমনও একজন আছেন, যিনি তাঁদের প্রতি অন্যায় মেনে নেবেন না৷''
তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং তো সংসদে বলেছেন, দমন নীতি প্রয়োগ করা হবে না৷ আশা করি, এইসব মানুষদের ফেরৎ পাঠানোও হবে না৷ তেমনটা করতে গেলে ভারতের একমাত্র বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে৷''
তা সত্ত্বেও প্রশ্ন থেকে যায়,নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ গেলেও এইসব মানুষগুলো কি আগের মতোই এ দেশে তাদের জীবিকা অর্জন, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা এবং বাসস্থানের সুযোগ পাবেন? নাকি পাবেন না? তাছাড়া ২০১৯ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন তাঁরা? তাঁদের সবাইকে কি শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হবে? তারপরেই বা কী হবে? ভারত ফিরিয়ে দিতে চাইলেই কি বাংলাদেশ এইসব মানুষকে ফিরিয়ে নেবে? তা না হলে এই লক্ষ লক্ষ মানুষ কী শরণার্থী শিবিরেই বাকি জীবন কাটাবেন? তাছাড়া ভারতে জন্মানো শিশুদের কী হবে? তারা কি ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করতে পারবে না? তাদেরও কি অবজ্ঞা করা হবে? নাকি এই ভাগাভাগি বন্ধ হবে কোনোদিন?