নারী ইউএনওরাও যৌন হয়রানির শিকার : টিআইবি
৫ নভেম্বর ২০২১তথ্যটি প্রকাশ করা হয় ‘স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উপজেলা নারী নির্বাহী কর্মকর্তার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে৷ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইউএনও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানায় টিআইবি৷
প্রতিবেদনটি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রাক্তন ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাহিদ শারমীন৷
২০২০ সালের জুন মাসের তথ্যের ভিত্তিতে দেশের ৪৮৫টি উপজেলার মধ্যে ১৪৯টি উপজেলায় কর্মরত নারী ইউএনওকে জরিপের জন্য ইমেলে প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়৷ তাদের মধ্যে ৪৫ জন জরিপে অংশ নেন৷ গুণগত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য মুখ্য তথ্যদাতা হিসেবে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা পর্যায়ে অন্যান্য সরকারি অফিসের কর্মকর্তা এবং প্রশাসন ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় বলে সম্মেলনে জানান নাহিদ শারমীন৷
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদে সাচিবিক সহায়তা দিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী ইউএনওরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আসা ‘অবৈধ আর্থিক সুবিধার' কারণে অনুমোদন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন৷ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে অনিয়ম করতে চাপের মুখে পড়ার কথা জানিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ ইউএনও এবং ২০ শতাংশ জানিয়েছেন, অতিরিক্ত ত্রাণ সামগ্রীর জন্য সুপারিশ করতে বাধ্য করার কথা৷
এছাড়া ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা বিভিন্ন মহল থেকে ব্যয়ের যথার্থতা যাচাই না করার চাপ আসার কথা জানিয়েছেন৷ ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ নারী ইউএনও ভুয়া ব্যয়ের বিল অনুমোদন এবং ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ নারী ইউএনও উপজেলা পরিষদের ক্রয় সংক্রান্ত কাজে অনিয়ম করতে বাধ্য করার কথা বলেছেন৷
২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ নারী ইউএনও দায়িত্ব পালনে সহকর্মীদের পক্ষ থেকে এবং ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ উপজেলা চেয়ারম্যানের ‘অসহযোগিতার' সম্মুখীন হওয়ার কথা জানিয়েছেন জরিপে৷ এছাড়াও দুর্নীতিবিরোধী কাজের ক্ষেত্রে ‘প্রতিবন্ধকতা' ‘অনৈতিক কাজের জন্য চাপ', উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজে বাধার সম্মুখীন হওয়া, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দপ্তরের সাথে সমন্বয়হীনতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে অসহযোগিতা, জেলা প্রশাসন থেকে যথাসময়ে সহযোগিতা না পাওয়া, স্থানীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা সচিবের ‘প্রভাব খাটানোর' সহ নানা অভিযোগ করেছেন জরিপে অনেক ইউএনও৷
টিআইবির জরিপ বলছে, দুর্যোগ মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন ৯৮ শতাংশ ইউএনও৷ করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন ৯১ শতাংশ নারী৷
এছাড়াও দুর্নীতির বিরদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনীতিবিদদের চাপের মুখে পড়েছেন ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ ইউএনও৷ ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ ইউএনও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, এমনকি সাংবাদিকের মাধ্যমেও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার কথা জানিয়েছেন জরিপে৷
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহযোগিতার কারণে ৫০ শতাংশ, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কারণে ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ , উপজেলা পরিষদের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার দ্বারা ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ, জেলা প্রশাসকের কারণে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কারণে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ ও সাধারণ জনগণের কারণে ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ ইউএনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কথা উঠে এসেছে জরিপে৷
স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের ভূমিকা আরও কার্যকর করতে আট দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি৷
নারী ইউএনওদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করার জন্য উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা পরিষদের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণের ওপর প্রশিক্ষণের আয়োজন করা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের এসিআরে জেন্ডার সংবেদশীলতাকে একটি সূচক হিসেবে রাখা দরকার৷
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার কাজে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ইউএনও এবং চেয়ারম্যানদের নিয়ে ওরিয়েন্টেশনের আয়োজন৷
দুর্নীতি প্রতিরোধে পদক্ষেপের জন্য নারী ইউএনওদের জেলা পর্যায়ে সম্মানিত করা এবং পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ সংবাদমাধ্যমগুলোকে স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যথাসাধ্য সঠিক সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে ইউএনওর কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিতে হবে৷
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘দেশে কর্মরত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের এক তৃতীয়াংশ নারী৷ আমাদের প্রশাসনিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশ জেন্ডার সংবেদনশীল নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক৷ নারী ইউএনওকে একজন মানুষ বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে না দেখে মূলত নারী হিসেবে দেখার প্রবণতা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ৷''
নারী ইউএনওরা সাংবাদিকদের কারণেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন বলে টিআইবির গবেষণায় উঠে এসেছে৷
কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় সাংবাদিকরা প্রভাবশালী মহলের সাথে যোগসাজশে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে থাকেন বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান৷
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)