নির্বাচনের পরের অর্থনীতি নিয়ে যত শঙ্কা
১ ডিসেম্বর ২০২৩আগামী ৭ জানুয়াারি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন৷ ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল৷ ৩০০ আসনের নির্বাচনে দুই হাজার ৭৪১ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন ৷ প্রতি আসনে লড়তে চাচ্ছেন গড়ে ৯ জনেরও বেশি প্রার্থী৷ নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০ টি দল নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে৷ তবে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ আরো কিছু দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না৷
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে নির্বাচন নিয়ে একটি বৈরি পরিস্থিতি চলছে৷ আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ আছে৷ কিন্তু তার মধ্যেও দেশ একপাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে৷ এই পরিস্থিতির কারণে সরকারের অর্থনীতির দিকে যে নজর দেয়ার দরকার৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী গত বুধবার বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে৷ বুধবারের আগে তা ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার ছিল৷ তবে দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলার৷
২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়৷ তা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ৷ এরপর থেকেই রিজার্ভের ‘ক্ষয়’ শুরু হয়৷ গত দুই বছর ধরে প্রতি মাসে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমেছে৷ আমদানি কমার পরও জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ডলার ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯৩ কোটি ডলার৷ ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না৷ অন্যদিকে রপ্তানি আয় কমছে৷
অক্টোবর মাসে ৩৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩.৬৪ শতাংশ কম৷ তবে আগের মাস সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে৷ তার আগের দুই মাস জুলাই ও আগস্টে রপ্তানি বেড়েছিল যথাক্রমে ১৫ ও ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ৷
প্রবাসী আয় কয়েক মাস কমে আবার বাড়া শুরু করেছে৷ নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে প্রবাসী আয় বেড়েছে৷ প্রথম ১৫ দিনে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি৷ গত বছর একই সময়ে এসেছিল ৯২ কোটি ডলার৷ কিন্তু এর ইতিবাচক প্রভাব রিজার্ভে পড়ছে না৷
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয় (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘যে অর্থনেতিক সংস্কারগুলো দীর্ঘদিন ধরে করা দরকার ছিল, সেগুলো আরো পিছিয়ে নির্বাচনের পরে করার কথা বলা হচ্ছে৷ এটা কোনো সঠিক চিন্তা নয়, কারণ, আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের এখন যা ধরন, সেটা দূর করতে পদক্ষেপ নিতে আমরা যদি আরো দেরি করি, তাতে সংকট আরো গভীর হবে৷’’
তার কথা, ‘‘মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের পতন যদি ঠেকানো না যায়, তাহলে সংকট আরো বাড়বে৷ এটার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যাপক সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক ঐক্যমত দরকার, সেটার কোনো লক্ষণ আমি দেখছি না৷’’
‘‘আমি আগেও বলেছি, বিদেশি ঋণে যেসব মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে, তার রিভিউ প্রয়োজন৷ এর প্রয়োজনীয়তার দিক বিবেচনা করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা প্রয়োজন৷ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি যেগুলো জরুরি নয় সেগুলো বাস্তবায়নের বাইরে রাখা উচিত৷ প্রতি বছরই আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে৷ আর এটা শোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায় (ডলারে)৷ আর এজন্য রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই৷ আমাদের দেখতে হবে যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো রপ্তানি উন্নয়নে ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কতটা কাজে লাগবে,’’ বলেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান৷
তার কথা, ‘‘মার্কিন শ্রম আইন নিয়ে আবার নতুন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিন্তু অতীতে শ্রম অধিকারের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করেনি৷ যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের পদক্ষেপের কথা বলছে, তাই নতুন শ্রম আইন নিয়ে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি আছে৷ নানা ধরনের স্যাংশনের কথা বলা হচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে শ্রম আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত করার ঝুঁকি আছে৷’’
নির্বাচনের পর সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কা
বাংলাদেশের ওপর বিদেশি ঋণের চাপ বাড়ছে৷ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার (১০ হাজার কোটি টাকা) ছুঁয়েছে৷ এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার৷ বাকি ২১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত৷ বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদী৷ বাকি ১৬ শতাংশ বা ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্বল্পমেয়াদী৷ এখন ঋণ জিডিপির অনুপাত ৪২.১ শতাংশ৷ গত ১০ বছরেই বিদেশি ঋণ বেশি নেয়া হয়েছে৷ তবে ২০১৭-১৮ অর্থ বছর থেকে বিদেশি ঋণ অনেক বাড়তে থাকে৷ ২০১৮-১৭ অর্থ বছর পর্যন্ত মোট বিদেশি ঋণ ছিল ৪৫.৮১ বিলিয়ন ডলার৷
জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট ১১০ কোটি ১৪ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার৷ চলতি অর্থবছরের চার মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে ৩৭ কোটি ৭২ লাখ ডলার৷
চলতি অর্থ বছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার শোধ করতে হবে৷ আগের অর্থ বছরে শোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার৷
ইআরডির তথ্য বলছে, আগামী অর্থ বছরে আসল পরিশোধ করতে হবে ২৯০ কোটি (২.৯ বিলিয়ন) ডলার, যা এর পরের অর্থবছরে বেড়ে হবে ৩৩১ কোটি ডলার৷ ২০২৭ সাল নাগাদ এটা ৫০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে৷
বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, ‘‘নির্বাচনের আগে থেকেই আমাদের যে ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে এর পিছনে আছে অর্থনীতির নীতির জায়গায় দুর্বলতা বা ভুল অর্থনৈতিক নীতির কারণে হয়েছে৷ অবশ্য এর সঙ্গে বৈশ্বিক কারণও আছে৷ এখন যদি নির্বাচনের পরেও একই অর্থনৈতিক নীতি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ার পাশাপাশি সক্ষমতা কমে আসবে৷ এটা একটা সংকট সৃষ্টি করবে৷ আমাদের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স যদি না বাড়ে, তাহলে ঋণ পরিশোধের চাপ সামলানো কঠিন হবে৷ আর সেই অবস্থায় যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে, আহলে আমাদের রপ্তানি আয় আরো কমে যাবে৷ রিজার্ভ পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা অতীতে দেখেছি, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন সব সময়ই অর্থনীতির জন্য ভালো হয়৷ কিন্তু এবার যেভাবে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে নির্বাচনের পর সবাই অনিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছেন৷ ফলে নির্বাচনের পর অর্থনীতির জন্য সুখবরের পরিবর্তে এখন যে চাপ আছে, তা আরো প্রলম্বিত হতে পারে৷’’
আর সিরডাপের পরিচালক অর্থনীতিবিদ অধাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো যারা একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, তাদের হয়ত আরো উদ্দেশ্য আছে৷ তাদের কথায় যে ফেয়ারনেসটা বাংলাদেশের ব্যাপারে দেখতে পাচ্ছি, সেটা কিন্তু ইসরায়েল ও হামাসকেন্দ্রিক ঘটনায় দেখতে পাচ্ছি না৷ আমরা যে ইস্যুগুলো পলিটিক্যালি দেখছি এবং যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কথা শুনছি এর সঙ্গে তো রাজনৈতিক বিষয় আছে৷ তাই যারা ক্ষমতায় আছে, তারা আবার ক্ষমতায় আসলে সেখানে অর্থনেতিক নিষেধাজ্ঞা চলে আসতে পারে৷ যদি সেটা না হয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও কিছুটা সুষ্ঠু হয়, তখন হয়ত ওই পরিস্থিতি না-ও হতে পারে৷’’
তার কথা, ‘‘এখন রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এমনিতেই অর্থনীতি চাপের মুখে আছে৷ যে ধরনের নির্বাচনের দিকে আমরা যাচ্ছি, তাতে অর্থনীতি আরো চাপে পড়তে পারে৷’’