নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারতকে বিপাকে ফেলা যায়নি
১৩ অক্টোবর ২০২৩১৯৯৮ সালের কথা৷ তখন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনের রাস্তার নাম ছিল রেসকোর্স রোড৷ তার সেই বাসভবনে তখন সাংবাদিক সম্মেলন হতো। অটল বিহারী বাজপেয়ী কখনো পঞ্চবটীতে এসে কখনো বা অন্যত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেন৷ সেদিন সাংবাদিক সম্মেলন হয়েছিল বাসভবনের পাশে পঞ্চবটী বলে একটা লনে৷ তবে সেদিনের সাজসজ্জা ছিল একটু বিশেষ রকমের৷ পিছনে ভারতের পতাকা কোনাকুনি করে রাখা৷ সামনে বাজপেয়ীর বলার জায়গা৷ সবকিছুর তদারক করতে ব্যস্ত প্রমোদ মহাজন৷
কিছুক্ষণ পর বাজপেয়ী এসে জানালেন, ভারত দ্বিতীয়বার পরমাণু বোমার পরীক্ষা করেছে৷ সাংবাদিক সম্মেলনে তখন পিন পড়লেও শব্দ পাওয়া যাবে৷ বাজপেয়ী কথা বলতেন ধীরে, একটু সময় নিয়ে নিয়ে৷ টিভি সাংবাদিকেরা বলতেন, প্রচুর ফুটেজ খান৷ সেই অল্প ব্যবধানকে মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময়৷ ধারে ধীরে বাজপেয়ী কিছুটা বিস্তারে বললেন ঘটনাটা৷ জানালেন, তিনি যাবেন পোখরানে৷
পরে প্রমোদ মহাজন বলছিলেন, নরসিমহা রাও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও চাপের মুখে পড়ে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলেন৷ বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, তাদের আরো একবার পরীক্ষা করা দরকার৷ সেই অনুমতি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন বাজপেয়ী৷ চরম গোপনীয়তা বজায় রেখে কাকপক্ষিও যাতে টের না পায়, তার ব্যবস্থা করে ভারত এই পরমাণু-পরীক্ষা করেছিল৷
তার সঙ্গে আরো একটা ব্যবস্থা করতে হয়েছিল বাজপেয়ীকে৷ কী করে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলা করতে হবে৷ পরমাণু-পরীক্ষার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল নিষেধাজ্ঞা৷ অ্যামেরিকা, ইউরোপের দেশগুলি তো বটেই, তাছাড়াও অনেকগুলি দেশ যে ভারতের উপরে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করবে তা জানা ছিল৷ ফলে তার জন্য আলাদা প্রস্তুতি নেয়ার দরকার ছিল৷ আর এটা ভারতের সেই সময়ের নেতাদের কছে ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷ নরসিমহা রাও যখন যখন এই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তিনি মনে করেছিলেন, এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা ভারতের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব নয়৷ আর বাজপেয়ী তো ছিলেন চরম আত্মবিশ্বাসী৷
তখন অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন যশবন্ত সিনহা৷ তিনি ও অন্য অর্থনীতিবিদরা বুঝিয়েছিলেন, কেন ভারতের ভয় নেই৷ পরিস্থিতিটা এরকম ছিল, যদি অশোধিত তেলের যোগান ঠিক থাকে, তাহলে ভারতের চিন্তার কোনো কারণ নেই৷ ভারত কৃষিতে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ৷ ফলে দেশের মানুষের কাছে চাল-গম ইত্য়াদির জোগান ঠিক থাকবে৷ নিষেধাজ্ঞা জারি করলে কিছুদিন একটু অসুবিধা হবে৷ কিন্তু ভারতের থেকে যে দেশগুলি নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, তাদের অসুবিধা কম হবে না৷ কারণ, তারা ভারতের বাজার হারাবে৷ তাদের কোম্পানিগুলির ক্ষতি হবে৷ চীনের বাইরে এতবড় বাজার তো আর নেই৷ এতবড় মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতিও নেই৷ তাই যশবন্ত জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারতকে বিপাকে ফেলা যাবে না৷ এনিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল৷ য়শবন্ত তার মতে স্থির ছিলেন৷
পরে দেখা গিয়েছিল সেই দাবি ঠিক৷ অ্যামেরিকা জুন মাসে ভারতের বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে৷ আর্থিক সাহায্য বাতিল করা হয়৷ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ জারি করা হয়৷ কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তারা যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়৷
জাপান বরং ২০০১ সাল পর্যন্ত আর্থিক নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছিল৷ তাদের একটা কারণও আছে৷ তারাই একমাত্র দেশ, যাদের পরমাণু বোমার ক্ষত বহন করতে হচ্ছে বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম৷ ইউরোপের দেশগুলিও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল৷ কিন্তু তাতে ভারতের বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি৷ শেষ পর্যন্ত সব নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে৷
এবারও ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিকায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পেয়েছি আমরা৷ অ্যামেরিকা, ইইউ বারবার করে ভারতকে বলেছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করতে হবে৷ ভারত তেল কেনার পরিমাণ কমানো দূরে থাক বরং বাড়িয়েছে৷ কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি৷ আসলে কোনো দেশই নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে চায় না৷ ভারতের কাছে বড় জোর হলো তার বিশাল বাজার৷ সেই বাজার পশ্চিমা দেশগুলির কাছে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে৷ ভারতের কাছে অন্যতম বড় সুবিধা হলো তার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব৷ তাই অ্যামেরিকাও এখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার রাস্তায় হাঁটছে৷
অ্যামেরিকা অবশ্য ১৯৯২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতের মহাকাশ সংস্থা ইসরোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিল৷ তাতেও ইসরোর যে খুব অসুবিধা হয়েছে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই৷
২০১৯ সালে ভারত বালাকোট অভিযান করে৷ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভিতর ঢুকে সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায় ভারত৷ তার প্রতিবাদে ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পাকিস্তান৷ ভারতের কোনো বিমানকে পাকিস্তানের আকাশসীমার মধ্যে ঢুকতে দেয়া হয় না৷ এই নিষেধাজ্ঞা নিয়েও ভারত যে চিন্তিত তা নয়৷
ভারতের নিষেধাজ্ঞা
ভারত অবশ্য নিজেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷ সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে ভারত নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিল৷ বর্ণবাদী নীতির প্রতিবাদে৷ ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল৷ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না৷ এমনকী খেলার ময়দানেও ভারত তাদের মুখোমুখি হত না৷
ফিজির বিরুদ্ধেও ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ভারত বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিল৷ ফিজির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পরই এই সিদ্ধান্ত নেয় ভারত৷
চীনের সঙ্গে লাদাখ নিয়ে সংঘাতের পর ভারত বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়৷ টিকটকসহ চীনের বেশ কিছু সামাজিক ও গেমিং অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়৷ মোট ৫৯টি চীনা অ্যাপ ভারতে নিষিদ্ধ৷
একটা সময় ভারতে কোক-পেপসিও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ পরে অবশ্য সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়৷ এখন কোক-পেপসি ভারতের ঠান্ডা পানীয়র জগতে রীতিমতো রাজত্ব করছে৷
আসলে নিষেধাজ্ঞা সব দেশই কমবেশি অবস্থান-সুযোগ-সুবিধামতো দিয়ে থাকে৷ তবে সেই নিষেধাজ্ঞা জারি হলেই কোনো দেশ বিপাকে পড়বে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই৷