নিষেধাজ্ঞায় কি কাজ হয়?
১৩ অক্টোবর ২০২৩একটি দেশ বা সেই দেশের কোনো সংস্থা ও নাগরিকের উপর চাপ দিতে অন্য দেশ ও সংস্থা নিষেধাজ্ঞার আশ্রয় নিয়ে থাকে৷ পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞাকে কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে৷ সাম্প্রতিক সময়ে চীনসহ আরও কয়েকটি দেশ নিষেধাজ্ঞা দেয়া শুরু করেছে৷ কিন্তু লক্ষ্য পূরণে এটি কতখানি কার্যকরী?
শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়৷ তখন থেকে অন্য দেশকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে৷গণতন্ত্রের উন্নয়ন, সন্ত্রাস দমন, মাদক পাচারসহ নানা ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ অনেক সময় জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে ঐসব দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে৷ এছাড়া সংস্থা দুটি স্বতন্ত্রভাবেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে৷ এসব নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে পালটা নিষেধাজ্ঞা দেয়ারও ঘটনা ঘটছে৷ যেমন চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় চীনও পালটা ব্যবস্থা নিচ্ছে৷
কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকরি? এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গবেষণা হয়েছে৷ কিছু গবেষণা বলছে, নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য সবসময় পূরণ হয় না৷ যেমন ইউরোপের দেশ বেলারুশের উপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি এখনও ইউরোপের একমাত্র স্বৈরতন্ত্র হয়ে আছে৷ এছাড়া কিউবা ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে অনেকদিন ধরে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দেশগুলোর শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসেনি৷ আর ভেনেজুয়েলার সরকার নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে কাজে লাগিয়েছে৷ নিজেদের দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনীতি খারাপ হলেও ভেনেজুয়েলার সরকার নাগরিকদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এমনটা হয়েছে৷ গণমাধ্যমের উপর সেন্সরশিপ থাকায় সে দেশের সরকার এটি করতে সফল হয়েছে৷
ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে কিনা, তা নিয়েও আলোচনা চলছে৷ যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা জোসেপ বরেল গত আগস্টে দাবি করেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইইউর দেয়া ১১ দফা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে৷ নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হয়েছে, দেশটির পণ্যের রপ্তানি গন্তব্য কমে গেছে এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় রাশিয়ার শিল্প ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা কমে গেছে বলেও মনে করছেন বরেল৷
নিষেধাজ্ঞা যেখানে কার্যকর হয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৫০-এর দশক থেকে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যেগুলো কার্যকর হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার প্রায় ৯০ ভাগই বহুদলীয় নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে, এমন দেশের উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল৷ নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে বই লেখা আগাথ ডেমোরে গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এই পরিসংখ্যান উল্লেখ করেন৷ ‘নিষেধাজ্ঞা কেন একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করে না' শীর্ষক প্রবন্ধটি মার্কিন সংস্থান্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির ‘ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর ডেমোক্রেটিক স্টাডিস'এর ‘জার্নাল অফ ডেমোক্রেসি'তে প্রকাশিত হয়েছে৷প্রবন্ধ প্রকাশের সময় ডেমোরে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল ফোরকাস্টিং ডাইরেক্টর ছিলেন৷ বর্তমানে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের সিনিয়র পলিসি ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন৷
ডেমোরে লিখেছেন, অনেক সময় নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশের জনগণকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করা হয়, যেন তারা সরকারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠেন৷ কিন্তু একনায়ক বা স্বৈরতন্ত্র আছে, এমন দেশের ক্ষেত্রে সেটি কার্যকর হয় না৷ কারণ সেসব দেশের জনগণের হাতে সরকারকে চাপ দেয়ার মতো অস্ত্র থাকে না৷ যেমন হয়ত সেসব দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না৷
আবার সংঘবদ্ধ হয়ে নিষেধাজ্ঞা না দিলে অনেকসময় নিষেধাজ্ঞা সফল হয় না বলেও মনে করেন তিনি৷ যেমন ডেমোরে লিখেছেন, কয়েকটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী করে ১৯৮০-র দশকে লিবিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ কিন্তু তাতে লিবিয়ার খুব বেশি সমস্যা হয়নি৷ কারণ গন্তব্য পরিবর্তন করে ইউরোপে তেল রপ্তানি শুরু করেছিল লিবিয়া৷ তবে পরবর্তীতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও লিবিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলে লিবিয়া পিছু হটেছিল৷
নিষেধাজ্ঞার কারণে একনায়কতন্ত্র বিদ্যমান দেশগুলোতে গণতন্ত্র পুরোপুরি না আসলেও এর মাত্রা বেড়েছে বলে ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে৷ জার্মান ইনস্টিটিউট অফ গ্লোবাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজের লিড রিসার্চ ফেলো ক্রিস্টিয়ান ফন জোস্ট ও লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের সুইডিশ রিসার্চ কাউন্সিল ফেলো মিশায়েল ভামান (বর্তমানে মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক) গবেষণাটি করেছিলেন৷
সমস্যায় সাধারণ মানুষ
নিষেধাজ্ঞার কারণে একটি দেশের সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়েন৷ গত মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোতে মৃত্যুর হার, দারিদ্র্য ও অসমতা বেড়েছে৷ আর কমেছে মানুষের আয় ও মানবাধিকার৷ নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নিয়ে করা ৩২টি গবেষণা বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের' সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ফ্রান্সিসকো রদ্রিগেজ৷
যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যারন স্নাইডার আল-জাজিরায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় একসময় ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল৷ তাতে কাজও হয়েছে৷ কিন্তু কিউবা এবং ভেনেজুয়েলায় ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার ফলে অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে৷ অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ কিন্তু সেইসব দেশে গণতন্ত্রীকরণ হয়নি৷
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণমাধ্যমকে কাজ করতে না দেয়া, রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বাধা দিতে আইন পাস- ইত্যাদি নানা কারণে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র৷
২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় বিভিন্ন নির্বাচনের আগে ও পরে কয়েক দফায় বিভিন্ন জনের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া সোমালিয়া, উগান্ডা, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিওন, বেলারুশ ও কম্বোডিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধেও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ফজলুল হালিম রানা মনে করেন, নাইজেরিয়ায় ভিসা নীতি কাজ করেনি৷ ‘‘আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় হলো নাইজেরিয়ায় ভিসা নীতি কাজ করেনি৷ উগান্ডা ও সোমালিয়াতেও নয়,'' বলে ডয়চে ভেলেকে জানান তিনি৷ ঐসব দেশ নিষেধাজ্ঞাকে আমলে নিচ্ছে না বলেও মনে করছেন অধ্যাপক রানা৷
বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার সাফল্য এখন পর্যন্ত সীমিত বলে গত জুনে লেখা এক প্রবন্ধেলিখেছিলেন আটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো আলী রীয়াজও৷
এদিকে বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণার আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের ব়্যাব এবং তার সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ ঐ পদক্ষেপের পর ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমে গিয়েছিল৷
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফজলুল হালিম রানা বলেন, ব়্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আসার পর সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছিল৷ ‘‘কিন্তু যখন বুঝতে পেরেছে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং তুলে নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, তখন আর বাংলাদেশ ঐদিকে তাকিয়ে নেই৷ বরং তারা ধরেই নিচ্ছে আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে, এবং সেটাই হয়েছে- ব়্যাবের নিষেধাজ্ঞার পর ভিসা নিষেধাজ্ঞা এসেছে,'' বলেন তিনি৷
ইইউর অন্য অস্ত্র
একটি দেশের উপর চাপ দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও উন্নয়ন সহায়তা কমানো ও বাণিজ্য সুবিধা প্রত্যাহারের মতো ব্যবস্থা নিয়ে থাকে৷ ইইউর নেয়া এসব পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লারা পোর্টিলা৷
সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়েছে৷ এতে বাংলাদেশের জন্য ‘এভরিথিং বাট আর্মস' বা ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়৷ ইবিএ কর্মসূচির মাধ্যমে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি সুবিধা পায় বাংলাদেশ৷ সে কারণে ইইউতে শুল্ক ছাড়াই পোশাক রপ্তানি সম্ভব হচ্ছে৷ ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল তালিকায় যুক্ত হলেও পরের তিন বছর সুবিধাটি থাকবে৷ তারপর এই সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস পেতে হবে৷ এ জন্য ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দেনদরবার চলছে৷
বাংলাদেশি পণ্যের অন্যতম বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৪৮ শতাংশের গন্তব্য ইইউভুক্ত দেশগুলো৷ ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ৯৩ শতাংশই তৈরি পোশাক৷
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি ফজলুল আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ইবিএ সুবিধা চলে গেলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে বিরাট ধস নামবে৷