পশুরাজ্যে হাসির পাত্র বাংলাদেশ
২৭ জানুয়ারি ২০১৬হাসলে দোষও দেয়া যাবে না৷ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন বলে যে কিছু একটা আছে এ কথা ক'জনই বা জানেন? জানেন যাঁরা, তাঁরা কি এ নিয়ে খুব একটা ভাবেন? কিছু করেন? মনে তো হয় না৷
বাংলাদেশে তো মানুষকেই প্রকাশ্যে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, পিটিয়ে, গুলি করে, এমনকি পায়ুপথে গরম বাতাস ঢুকিয়েও মেরে ফেলা যায়৷ জনতা আর ‘ক্ষমতা'-র টনক নড়লে কখনোসখনো হত্যাকারীর বিচারও হয়৷ কিন্তু অন্য বা বণ্যপ্রাণী হত্যার কি বিচার হয়? কোনো প্রাণী অধিকার কর্মী কি কখনো হত্যার বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামেন? প্রাণীর অধিকারের জন্য তাঁরা কি সময় এবং বিবৃতি ‘ব্যয়' করেন?
প্রাণী অধিকার সংস্থা বা প্রাণী অধিকার কর্মী বলে কি বাংলাদেশে আদৌ আছে কিছু? থাকলেও তাঁদের উপস্থিতি তো কখনো অনুভূত হলো না! মানবাধিকার সংস্থা, মানবাধিকার কর্মীর কথা তো প্রায়ই শুনি, সময় বিশেষে তাঁদের নানা তৎপরতাও দেখি৷ কিন্তু প্রাণী অধিকার সংস্থা বা প্রাণী অধিকার কর্মীর কথা তো কখনো খুব একটা শুনলাম না৷
রাজন হত্যার দিনেই আমরা আরেকটি ‘প্রাণ' হত্যার রোমহর্ষক দৃশ্য দেখেছিলাম৷ চট্টগ্রামে এক প্রবাসী সেদিন এক হরিণ শাবককে খাবার দিয়ে ভুলিয়েভালিয়ে নিকটতম দূরত্বে এনে সহজতম নিশানা বানিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল৷ হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে মৃত হরিণের পাশে দাঁড়িয়ে সদলবলে ফটোসেশনও সেরেছিল লোকটি৷ পুরো দৃশ্য ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভিডিওচিত্র শেয়ারও করেছিল সেই মানুষ৷ সংবাদপত্রে অবশ্য তার মনুষত্ব নিয়ে যৌক্তিক কারণেই সংশয় প্রকাশ করে শিরোনাম দিয়েছিল, ‘কে পশু?'
কই তখনো তো কোনো পশু অধিকার কর্মী বা সংস্থার তৎপরতা দেখা গেল না! সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সব পেশার সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘটনাটিতে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া হয়েছিল৷ কিন্তু রাজনের হত্যাকাণ্ডের কারণে হরিণ শাবক তখনো পর্যাপ্ত মনযোগ পায়নি৷
তবে ‘কে পশু?' – প্রশ্নের উত্তর আমরা খুব তাড়াতাড়িই পেয়েছিলাম৷ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, যিনি গুলি করে হরিণশাবকটিকে হত্যা করেছিলেন, মানুষের ভাষা অনুযায়ী তার আচারআচরণ ‘পাশবিক' হলেও, তিনিই আসলে ‘মানুষ'৷ তিনি মানুষ, কারণ, পরিস্থিতি বুঝে ঝটপট বিমানে চেপে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যেতে পেরেছেন৷
‘অমানবিক' কাজ করে মানুষই তো পারে এভাবে গা ঢাকা দিতে৷ পশু কি পারে এমন? পশু, সে যত ভয়ংকর, যত হিংস্রই হোক, সে পর্দার আড়ালে মুখ ঢাকতে পারে না, স্বভাব লুকাতে পারে না, তারা ‘ফাঁদ' চিনতে, ‘টোপ' বুঝতে ভুল করে৷ বড় আত্মঘাতী ভুল৷ মানুষকে বিশ্বাস করা, মানুষের কাছে আসা, বাধ্য হয়ে মনুষ্যসমাজে থাকা অনেক সময়, সেই ভুলেরই খেশারত৷
আইন তাকে বাঁচাতে পারে না৷ পশু হত্যার বিচারের দাবি নিভৃতে, বিদ্রুপে হাসে৷ নিরীহ হরিনশাবকেরা হিংস্র মানুষকে হয়ত কটাক্ষ করে, মরার পরেও হয়ত তারা আমাদের নিয়ে হাসে!
হরিন, কুকুর, বিড়াল, বাঘ বা এখনো টিকে থাকা অন্য কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে প্রতিদিন কত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, তার হিসেব রাখারও কেউ নেই৷ নির্বিচারে চলছে পশু হত্যা৷ খবরের কাগজে অনেক সময়ই দেখি এমন দৃষ্টান্ত৷
জার্মানিতে একদিন লোকালয়ের এক নির্জন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে বাঁধা পেয়েছিলাম৷ একজন আমাকে এসে বলেছিল, ‘‘আস্তে হাঁটুন, প্লিজ৷ দয়া করে হাঁটার সময় রাস্তার দিকে নজর রাখুন৷ আপনার অসতর্কতার জন্য পায়ের নীচে পড়ে কোনো ব্যাঙ হয়ত মারা যাবে৷''
টানেনবুশের সেই ব্যাঙরাজ্যে আমি সেদিন থমকে দাঁড়িয়েছিলাম৷ ব্যাঙদের বাঁচিয়ে রাখতে বাকি সময়টা খুব সাবধানেই সেদিন পথ চলেছি৷ এখানে কিছু পথ ব্যাঙের জন্যও কত নিরাপদ৷ আর আমাদের দেশে? সেদিনও শাহবাগ এলাকাতেই পৃথক দু'টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল দুই কিশোরীর৷ অনেকেই বললেন, ওদের মৃত্যু দুর্ঘটনা ছিল না, হত্যাকাণ্ডের শিকার তারা৷ বেপরোয়া, বেসামাল চালকদের ‘হত্যাকারী' বলার পক্ষে অনেক যুক্তিও দেখানো যাবে৷ কিন্তু কোনো চালকের শাস্তি দাবি করে লাভ হবে না৷ দেশব্যপী ধর্মঘট হবে৷ মন্ত্রী বলবেন, গরু-ছাগলের ছবি সম্বলিত চিহ্ন বুঝতে পারাই দক্ষ চালক হওয়ার জন্য যথেষ্ট৷ সুতরাং ‘দক্ষ' চালক, তাদের উপযুক্ত মন্ত্রী এবং সেই হিসেবে যেমনটি হওয়ার কথা সেরকম রাস্তাঘাটে মানুষ নামে প্রাণটা হাতে নিয়ে৷ আর পশু? ওদের তো হাত নেই, তাই মানুষের হাতে-পায়েই তারা সঁপে দেয় প্রাণ৷ প্রাণ গেলে কেউ বিচার চায় না, পায়ও না৷
অথচ প্রাণী হত্যার বিচার ভারতেও হয়৷ অনেক বছর আগে থেকেই হয়ে আসছে৷ সালমান খান, সাইফ আলী খানসহ অনেকেরই এ অভিযোগে আদালতে গিয়ে কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হয়৷
বাংলাদেশও কাঠগড়াতেই দাঁড়িয়ে আছে৷ পশুদের আদালতের কাঠগড়ায় আমরা সবাই হত্যাকারী অথবা হত্যায় প্রশ্রয়দানকারী৷ পশুরা আমাদের বিচার করতে পারে না৷ কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একটি জাতির উদ্দেশ্যে তারা শুধু বিদ্রুপের হাসি হাসে৷
বন্ধু, আপনি কি আশীষ চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে একমত? জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷