‘কালা-দিবস' পালন
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩১১ বছরের এক স্কুলছাত্রীর অকালমৃত্যু নিঃসন্দেহে এক দুঃখজনক ঘটনা৷ কিন্তু তার পর স্কুলে ঢুকে হাঙ্গামা, ভাঙচুরের যে নিন্দনীয় ঘটনা ঘটালেন ছাত্রীর অভিভাবক আর বহিরাগত কিছু লোক, তা হয়ত আরও ন্যক্কারজনক৷ কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি ক্রমশ আরও জটিল হয়ে পড়াতে অনেকের কপালেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ৷ কারণ, বিষয়টা এখন ছাত্রীমৃত্যু এবং স্কুলে ভাঙচুরের মধ্যেই কেবল আবদ্ধ নেই৷ বরং অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ এনেছেন কলকাতা শহরের আর্চবিশপ এবং স্থানীয় রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সমাজের প্রধান৷
কলকাতার আর্চবিশপ অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ বর্তমান রাজ্য সরকার৷ সম্প্রতি ছাত্রী-মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় কলকাতার ক্রাইস্ট চার্চ মিশনারি স্কুলে যে হাঙ্গামা এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে, পুলিশ তাতে নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল৷ কাজেই উত্তেজিত জনতা নয়, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তাই ওই হাঙ্গামার জন্য দায়ী বলে আর্চবিশপের অভিমত৷ ভারতে এই প্রথম কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এত সরাসরি নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার দায়ে অভিযুক্ত করল কোনো সরকারকে, যার জবাব সরকারের তরফ থেকে এখনও দেওয়া যায়নি৷
স্কুলে হাঙ্গামার সময় ওই প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক হাজার খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুল এবং কলেজ ১৯শে সেপ্টেম্বর এক দিনের প্রতীকী বনধ করবে৷ এমন প্রতিবাদ মিশনারি স্কুলগুলির দিক থেকে সম্ভবত এই প্রথম৷ রাজ্যের কিছু আইসিএসই, অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষা পর্ষদের আওতাভুক্ত স্কুলও এই একদিনের প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে৷ ছাত্রী-মৃত্যুর ঘটনার দায়ে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের মহিলা প্রিন্সিপালকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল, সেই হেলেন সরকার তিন দিন পর আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন৷ প্রতিবাদ কর্মসূচি কিন্তু তাতে থেমে থাকছে না৷ আর্চবিশপ উল্টে অভিযোগ এনেছেন যে, পুলিশ জোর করে ওই প্রিন্সিপালকে দিয়ে ইস্তফা-পত্র লিখিয়ে নিয়েছিল৷
ঘটনা হচ্ছে, আদতেই পুরো ঘটনার দায়, অর্থাৎ এক ছাত্রীর অকালমৃত্যু এবং পরবর্তী জনরোষ ও স্কুল ভাঙচুরের ঘটনার দায় পরোক্ষে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং তার প্রধানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল পুলিশ৷ কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে এখন পুলিশের তদন্তকারী অফিসাররা সন্দেহের লক্ষ্য করেছেন মৃতা ছাত্রীর পরিবারকে৷ প্রকৃত সত্যি যদি তাই-ই হয়, তা হলে কেন প্রথমেই স্কুলের মহিলা প্রিন্সিপালকে গ্রেপ্তার করার মতো এক অবিবেচক পদক্ষেপ পুলিশ নিল, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়ও থেকেই যায়৷
কেন পুলিশ এই উল্টোমুখে হাঁটা শুরু করল, তার অবশ্যই কারণ আছে৷ কলকাতার এই ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলটি ১৩১ বছরের পুরনো একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুল৷ এই দীর্ঘ সময়ে স্কুলের বহু ছাত্রী পড়াশোনা শেষ করে আজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত৷ স্কুলের বদনাম এবং ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষুব্ধ এই প্রাক্তন ছাত্রীরাই এই দুঃসময়ে ক্রাইস্ট চার্চের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং পত্র-পত্রিকায় নিজেদের মতামত জানাচ্ছেন৷ অন্যদিকে বেনজিরভাবে কলকাতার রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সমাজের প্রধান রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সরব হয়েছেন প্রশাসনিক অপদার্থতার বিরুদ্ধে৷ এই জোড়া প্রতি আক্রমণের মুখে নিজেদের সাজানো তদন্ত থেকে পিছিয়ে এসে ঠিক রাস্তায় হাঁটতে কার্যত বাধ্য হলো পুলিশ৷
এদিকে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ওই ঘটনা নিয়ে সুযোগসন্ধানী রাজনীতি এবং চাপানউতোর যথারীতি শুরু হয়েছে৷ ঘটনার পর রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, শ্রম মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু নিহত ছাত্রীর বাড়ি গিয়েছিলেন৷ এর পরেই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, সিপিএম-এর সূর্যকান্ত মিশ্র মেয়েটির বাড়ি যান৷ সঙ্গে সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলতে শুরু করেছেন, স্কুলে যারা হামলা-ভাঙচুর করেছে, তারা সবাই সিপিএমের লোক৷ যদিও তেমন কোনও তথ্য-প্রমাণ এখনও প্রশাসনের হাতে আসেনি৷
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-কলেজে হাঙ্গামা এবং শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা বেড়ে যাওয়াতে রাজ্যপাল উদ্বেগ প্রকাশ করে, অবাধ্য ছাত্রদের কঠোর হাতে শায়েস্তা করার কথা বলেছিলেন৷ তাতে এক কালের ছাত্রনেতাদের গোঁসা হয়েছিল এবং তাঁদের মনে হয়েছিল, রাজ্যপাল অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করছেন৷ কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য যে এই শাসনের অভাবে আরও চেপে বসছে, সেটা যেন কারও চোখে পড়ছিল না৷ ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে বহিরাগতদের হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা কী অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে৷