পশ্চিমবঙ্গে স্কুল ছুটি কেন?
২৫ মে ২০১৯চলতি মে মাসের গোড়ার দিকে দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের দিকে ধেয়ে এসেছিল ঘূর্ণিঝড় ফণি৷ পশ্চিমবঙ্গেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আভাস দিয়েছিল আবহাওয়া দপ্তর৷ তার জেরেই রাজ্য সরকার তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেয়, স্কুলে ছুটি দেওয়া হবে৷ প্রতি বছরের মতো গরমের জন্য স্কুল ছুটি দেওয়ার কথাই ছিল৷ ফণির আতঙ্কে গরমের ছুটি এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা দপ্তর৷ তারা নির্দেশিকা জারি করে বলে, ৬ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে স্কুল৷ এই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় রাজ্যে৷ শিক্ষামহল থেকে শুরু করে অভিভাবকরা প্রশ্ন তোলেন দীর্ঘ ছুটির ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার ব্যাপক ক্ষতি হবে৷ এই ক্ষতি পরে সামলে ওঠা যাবে না৷ নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি ক্লাসে পড়ানোর সময় পাবেন না শিক্ষকেরা৷ এ নিয়ে শিক্ষক মহলের একাংশের মধ্যেও রয়েছে ক্ষোভ৷
আপত্তি শিক্ষামহলেই
রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু করে পড়ুয়ারা৷ তাদের সঙ্গে ছিলেন অভিভাবকরাও৷ উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে৷ অবিলম্বে স্কুল খোলার দাবিতে ডুয়ার্সের নাগরাকাটায় পড়ুয়ারাই শহর পরিক্রমা করে আন্দোলন করে৷ তা নিয়ে সরকারের অবশ্য হেলদোল নেই৷ অভিভাবকদের বক্তব্য, ঘূর্ণিঝড়ের নামে ছুটি এগিয়ে এনে ও বাড়তি ছুটির ব্যবস্থা করে সরকার শিক্ষা-ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করেছে৷ গঙ্গারামপুরের অভিভাবক বিবেকানন্দ গায়েনের বক্তব্য, ‘‘আমার ছেলে সরকারি স্কুলে পড়ে৷ এমনিতেই সিলেবাস শেষ হয় না৷ নানা কারণে স্কুল ছুটি থাকে৷ প্রাইভেট টিউশন যাদের নেই, তাদের ক্ষেত্রে একটানা স্কুল বন্ধ থাকলে যে পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যাবে৷'' দশম শ্রেনির পড়ুয়া সৌম্য রায় বলে, ‘‘কিছু প্র্যাকটিকেলের কাজ স্কুলেই ভালো করে হয়৷ সেগুলো তো আর প্রাইভেট টিউশনি দিয়ে হবে না৷ সে ক্ষেত্রে খুব অসুবিধায় পড়ছি৷'' শিক্ষকদের একাংশও এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, যদিও তাঁরা সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বনামে মুখ খুলতে নারাজ৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহরমপুরের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাৎসরিক ক্যালেন্ডার ধরে আমাদের পঠনপাঠন এগোতে হয়৷ প্রতি বছরই ২০-২৫ দিন গরমের ছুটি থাকে৷ কিন্তু তার থেকে বেশি ছুটি থাকলে পড়ানোর কাজটায় বাধা পড়ে৷ প্র্যাকটিকেল ক্লাসের ক্ষেত্রে সমস্যা আরো বেশি৷ ছুটির মধ্যেই ২১ মে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে৷ উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো কাজই করা যাচ্ছে না৷''
মিড ডে মিলের ক্ষেত্রে সমস্যা
রাজ্য সরকার ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি প্রচণ্ড দাবদাহকে কারণ হিসেবে তুলে ধরেছে৷ কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সেজন্য গরমের ছুটি প্রতি বছরই থাকে৷ সেটা এতটা বাড়িয়ে দেওয়ার কী যুক্তি রয়েছে? এখন ভারতের স্কুলে একটি পর্যায় পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের দুপুরের আহার দেওয়া হয়৷ এই মিড-ডে মিল দেওয়ার লক্ষ্য, দরিদ্র পরিবারের পড়ুয়াদের স্কুলে টেনে আনা৷ এতে তাদের অন্নের চাহিদা মিটবে, একইসঙ্গে শিক্ষা দেওয়া যাবে৷ স্কুলছুটদের সংখ্যা কমানোও ছিল মিড-ডে মিল চালুর লক্ষ্য৷ কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকলে দুপুরের খাবার মিলবে না৷ অর্থাৎ শুধু পড়াশোনার ক্ষতি নয়, অনেক ছেলেমেয়ে একবেলার আহার থেকেও বঞ্চিত হবে স্কুল বন্ধ থাকায়৷ মিড-ডে মিলের সঙ্গে স্কুলে আয়রন ট্যাবলেট দেওয়া হয়৷ সেটাও পাবে না কচিকাঁচারা৷ এর ফলে অপুষ্টিতে ভোগার আশঙ্কা বাড়বে৷ পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল এলাকার বেলপাহাড়ির একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বলেন, ‘‘আমার স্কুলের ১৮৬ জন পড়ুয়া আছে৷ এরা সবাই মিড-ডে মিলের উপর একবেলা নির্ভর করে৷ কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকলে ওদের দুপুরের খাবার দেওয়া যাবে না৷ সুতরাং এই অবকাশ ওদের কাছে খুবই সমস্যার৷'' অনেকের মতে, এর ফলে স্কুলছুটদের সংখ্যা আবার বাড়বে৷ স্কুল ছুটি দেখে গরিব বাবা-মায়েরা সন্তানদের আবার কাজে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন৷ সমাজকর্মী আব্দুল হালিম জানান, ‘‘বিড়ি শ্রমিকের কাজ করে বহু শিশু৷ তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য হতে পারে যে কোনো সময়েই৷''
নেপথ্যে রাজনীতি?
রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের পিছনে এসব কারণ ছাপিয়ে উঠে আসছে রাজনীতির প্রসঙ্গ৷ বিরোধীরা বলছে, ভোটের কথা ভেবেই নিখাদ এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত৷ শিক্ষকদের আর্থিক দাবিদাওয়া পূরণের আশু সম্ভাবনা না থাকায় ছুটি দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে চেয়েছে সরকার৷ লোকসভা নির্বাচনে শিক্ষক ও তাঁর পরিবারের ভোটকে নিজেদের অনুকূলে আনতে এই কৌশল নিয়েছিল রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস৷ ভোটকর্মীদের একাংশ নির্বাচনের আগেই রাজ্যে হিংসার বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন৷ তাঁরা নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার দাবি তোলেন৷ এই ভোটকর্মীদের একটা বড় অংশ শিক্ষক৷ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, ক্ষোভ সামাল দিতে ছুটির দাওয়াই দিয়েছিল তৃণমূল সরকার৷ যদিও নির্বাচনের ফলে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি৷
বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ও অল বেঙ্গল স্টেট এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গরমেও স্কুল চালানোর একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে৷ বেসরকারি স্কুল দিব্যি চলছে৷ গরমই যদি কারণ হয়, তাহলে বিকল্প পথে সকালের দিকে মর্নিং স্কুল খোলা হচ্ছে না কেন? আর ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ ছিল দু-তিনদিনের জন্য৷'' রাজনীতি প্রসঙ্গে শিক্ষা প্রশাসন ও আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত কার্তিকের বক্তব্য, ‘‘শিক্ষকদের একটু ফুরসত দিতে চেয়েছে রাজ্য সরকার৷ ভোটের কাজ করতে যেতে তাঁদের ছুটির জন্য তদ্বির করতে হয়৷ টানা ছুটি দিয়ে সেই ঝক্কি দূর করা হয়েছে৷ এর ফলে রাজ্য সরকারের প্রতি শিক্ষকদের মনোভাব ভালো হবে৷ কিন্তু, এতে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷''
শাসক দল অনুমোদিত সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণেন্দু বিষই ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার পিছনে নির্দিষ্ট ভাবনা রয়েছে৷ তবে দরকার পড়লে ছুটি কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে, এ কথাও বলা হয়েছে৷ রাজ্যে তাড়াতাড়ি বর্ষা এলে ৩০ জুন পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রাখা না-ও হতে পারে৷ সেক্ষেত্রে ছুটি অনেকটাই কমে যাবে৷'' মিড ডে মিলের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘পুজোর ছুটির সময়েও তো পড়ুয়ারা মিড ডে মিল পায় না৷ তাছাড়া এখন ২টাকা কিলো দরে চাল পাচ্ছেন মানুষ৷ এত দারিদ্র্য নেই যে পড়ুয়াদের মিড ডে মিলের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে৷''
কার্তিক মান্নার কথায়, ‘‘শিক্ষকেরা বা ছাত্ররা কেউই এত ছুটি চাইছেন না৷ জোর করে ছুটি দেওয়া হচ্ছে৷ শিক্ষাবিরোধী এই দৃষ্টিভঙ্গি আদতে শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের চেষ্টা৷ এর বিরোধিতা চলছে৷ পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা আসে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে৷ তখন গরমের দাপটও থাকে না৷ ফলে ছুটিটা নিষ্প্রয়োজন ও অযৌক্তিক৷'' সোশাল মিডিয়ায় নানারকম মিম ও জোক ঘোরাঘুরি করছে এই নিয়ে৷ সেখানে অনেকে টিপ্পনি কেটেছেন, মিড ডে মিলের খরচ কমাতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত৷ অনেকে বলছেন, ঝড় আসার আগেই স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে৷ উন্নয়নের চোটে সে স্কুল আর খোলা হয়নি৷ আপাতত দাবদাহ কমলে স্কুল খোলে কিনা, সেটাই দেখার৷