সাধনা নেই, আছে শুধু প্রচারসর্বস্বতা
১৪ ডিসেম্বর ২০১৭কেন তাঁর এই সরে যাওয়া? আজকের লোকসংগীত নিয়ে তাঁর অভিমতই বা কী? বীরভূমের সিউড়িতে লোকশিল্পী স্বপ্না চক্রবর্তীর মুখোমুখি হয় ডয়চে ভেলে৷ ৮০-৯০ দশকে রেকর্ডের কভারে ছাপা সেই তরুণীর সঙ্গে আজকের মানুষটির মিল খুঁজে পাওয়া ভার৷ সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডের কাছে একতলার সুন্দর অ্যাপার্টমেন্টে তাঁকে পাওয়া যায়৷ সঙ্গে ছিলেন স্বামী সুরকার ও গীতিকার মানস চক্রবর্তী৷
ডয়চে ভেলে: ১৯৭৮ সালে আপনার জয়যাত্রা শুরুর গল্পটা বলুন৷ সেটাই সবাই শুনতে চায়...
স্বপ্না চক্রবর্তী: যাত্রা শুরু যদি বলতে হয়, তাহলে তা ৭৮-এর আগেই৷ ১৭ বছর বয়সে ফুড অ্যান্ড সাপ্লাই রিক্রিয়েশন ক্লাবের মঞ্চে আমার গান মানুষের পছন্দ হয়৷ সেখান থেকেই আমার নাম হয় ‘বীরভূমের লতা'৷
না, আমি সেই গোড়ার কথা বলছি না৷ বলছি ‘বড়লোকের বিটি'-র কথা....
সেই সালটা ভোলার না৷ ১৯৭৮৷ বিরাট বন্যা হয়েছিল৷ সে বছর প্রথম এই দুটো গান রেকর্ড করি৷ অশোকা কোম্পানির ঈগল কমার্শিয়াল রেকর্ড করে৷ যদিও দু'বছর আগে জেলা বেতার অনুষ্ঠানে এই দু'টো গান গেয়েছিলাম৷ সবাই পছন্দ করেছিলেন৷ রেডিওতে সরাসরি ‘বি-হাই' শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছিলাম৷ প্রত্যেক মাসে অনুষ্ঠান করেছি৷ কিন্তু দু'বছর পর রেকর্ড যে এত জনপ্রিয় হবে, সেটা ভাবতেও পারিনি৷ পুজোর আগেই আমার রেকর্ড বেরিয়েছিল৷ চারদিকে সে গান বাজত৷ ওই দু'টি গানই স্বপ্না চক্রবর্তীকে চিনিয়ে দিলো৷ সে সময় আমার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘বড়লোকের বিটি'৷
তখন তো টিভিই আসেনি৷ মানুষ আপনাকে চিনতে পেরেছিল?
না, মুখ চেনার সুযোগ ছিল না৷ ‘বড়লোকের বিটি'-র কভারে আমার ছবিও ছিল না৷ কিন্তু জনপ্রিয়তাটা বুঝতে পেরেছি নানা ঘটনায়৷
তেমন দু-একটা ঘটনার কথা বলুন না...
(হেসে) সে তো নানা মজার ঘটনা৷ একবার ট্রেনে ফিরছি৷ শুনছি দু-তিনজন প্রবীণ মানুষ আমাকে নিয়ে আলোচনা করছেন৷ একজন বলছেন, ‘যে মেয়ে গানটা গেয়েছে, তার একটা চোখে নষ্ট হয়ে গেছে৷' আমি ভাবলাম বলি, মোটেই তা নয়৷ কিন্তু আমাকে তো চেনে না কেউ৷ বললে যদি পাগল ঠাওরায়, সেই ভয়ে বলিনি৷ একবার একটা গ্রামে গেছি অনুষ্ঠান করতে৷ গ্রামের মহিলারা আমার কাছে এসে মুখের ওপর আলো ধরেছেন৷ তারপর আমার গা টিপে টিপে দেখছেন৷ সেটা দেখে নিজেদের মধ্যে ওঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, এ তো আমাদের মতোই গো! এ সব ঘটনা এখনও ভাবলে ভালো লাগে!
‘ফোক', মানে লোকসংগীতে এলেন কেন?
ফোকের তখন এমন চর্চা ছিল না৷ তেমনভাবে শোনা হতই না৷ তবে আমার ফোক ভালো লাগত৷ তাছাড়া আমাদের ‘আনন' নামে একটা গোষ্ঠী ছিল, এখনও আছে৷ সেখানে সংস্কৃতি চর্চা হতো৷ আমি গানের দিকটা দেখতাম৷ আমাদের বীরভূমের লুপ্তপ্রায় ফোক ঝুমুর, ভাদু, মনসা, কোঁড়া – এ সব যাতে আরও প্রচার পায়, সে জন্য আমরা গাইতাম৷ এভাবেই একদিন স্বপ্না চক্রবর্তী হয়ে গেলাম৷
সে সময় কত গান আপনার — ‘বর এলো মাদল বাজায়ে', ‘কাঠ কুড়াতে বেলা যায়', ‘বনমালী তুমি', ‘আমার কচি ছানাটা বড়' – এমন কত গান৷ ওপার বাংলায় আপনার গান কি পৌঁছেছিল সে সময়?
নিশ্চয়ই গিয়েছিল৷ তার প্রমাণ একটা ঘটনায় পেয়েছিলাম৷ ‘বড়লোকের বিটি' রেকর্ড বেরোনোর বছর দু-তিনেক পর বোলপুরের পৌষমেলায় গেছি৷ মেলায় একটা রেকর্ডের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি৷ দু'জন ভদ্রলোক এলেন৷ তাঁরা নিজেদের বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে আমার রেকর্ডখানা চাইলেন৷ বিক্রেতা বললেন, বাড়তি দাম দিতে হবে৷ কত দাম জানেন?
কত?
২৭৫ টাকা৷ তখন একটা রেকর্ড ১৬ টাকায় বিক্রি হতো৷ কালোবাজারি বলতে পারেন৷ বিক্রেতার আরও একটি শর্ত ছিল — স্বপ্না চক্রবর্তীর গান কিনলে সঙ্গে আরও একটি রেকর্ড কিনতে হবে!
ওঁরা কিনলেন?
হ্যাঁ, কিনলেন তো! ওপার বাংলার ওই দু'জন ভদ্রলোক ২৭৫ টাকাতেই আমার রেকর্ড কিনলেন এবং সঙ্গে অন্য রেকর্ডটিও৷ আরও অবাক লাগার মতো ঘটনা, সেই রেকর্ডই আমাকে কিনতে হয়েছিল, কোম্পানি দেয়নি৷
সৌজন্য হিসেবে শিল্পীর কপি দেয়নি?
না৷ রেকর্ড চাইতে ঈগলের কলকাতা অফিসে গিয়েছিলাম৷ তাঁরা তো আমাকে চিনতেই পারেন না! ওই যে বললাম, কভারে ছবি ছিল না৷ শেষমেশ বাজার থেকে একটা রেকর্ড কিনে বাড়ি ফিরে শুনেছি৷ আজকের দিনে এটা ভাবা যাবে?
মিডিয়ার দাপটে আজ সংস্কৃতিচর্চার চেহারাটাই বদলে গেছে৷ তারা শুধু প্রচার করে শিল্পী তৈরি করছে বলে অভিযোগ ওঠে৷ তাঁরা জনপ্রিয়তা ও পুরস্কারও পাচ্ছেন৷ আপনার সেই জনপ্রিয়তার পাশে আজকের এই মিডিয়া নির্ভর প্রচারকে কোন জায়গায় রাখেন?
অভিযোগ নয়, এটাই সত্যি৷ আজ সবাই রিয়েলিটি শোতে এসে শিল্পী হয়ে যাচ্ছে৷ তাদের ঠিকঠাক চর্চাই নেই, সাধনা দূরের কথা৷ এই তো সেদিন দেখলাম, একটি মেয়ে আমার একটা গান গাইল৷ বিচারক তাকে ডিজ্ঞেস করলেন, এটা কার গান? মেয়েটা স্পষ্ট বলল, সে জানে না৷ এরা কার গান গাইছে, সেটারও খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করে না৷ এ সব দেখলে খারাপ লাগে৷ তাও ওই মেয়েটার বাড়ি বোলপুর, নাম বলতে চাইছি না৷
আপনাদের সময়ে চর্চা নিশ্চয়ই সাধনা হয়ে দাঁড়াত...
তখন চর্চা না করলে বড় হওয়া যেত না৷ তাই রীতিমতো সাধনা দরকার ছিল৷ বড়দের কাছ থেকে শেখার আগ্রহ ছিল৷ পাঁচ বছর শান্তিনিকেতনে সংগীত শিক্ষার সময় কত ভালো শিক্ষককে পেয়েছি৷ পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভি বালসারা, নির্মলেন্দু চৌধুরীদের কাছ থেকে শিখেছি৷ আমরা যেমন সম্মান করতাম, অগ্রজরা তেমনই প্রাণ ঢেলে শেখাতেন৷
স্বর্ণযুগের এই শিল্পীদের সঙ্গে আপনার তো প্রচুর স্মৃতি রয়েছে...
হ্যাঁ, সে সব বলতে শুরু করলে আর শেষ হবে না৷ নির্মলেন্দু চৌধুরী একবার বলেছিলেন, ‘স্বপ্না, তুই লোকসংগীতকে আবার জনপ্রিয় করে তুলেছিস৷ শহরের মানুষেরা লোকগান শুনলে রেডিও বন্ধ করে দিত৷ তুই ছোটলোকদের গান শুনতে বাধ্য করিয়েছিস৷' এর থেকে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে! মানবদা (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়) মনসামঙ্গল-এর রেকর্ডিংয়ের সময় যে কথাটা বলেছিলেন, এখনও মনে আছে৷ আশির দশকের শেষভাগ৷ মানবদা বললেন, ‘তোমার বড়লোকের বিটি দশ বছর পরও মানুষ শুনছে৷ আরও কয়েক বছর টিকে থাকলে বলা যাবে, এই গান কালজয়ী হয়েছে৷
আজ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নেই৷ কিন্তু তার কথা সত্যি হয়ে গেছে৷
হ্যাঁ, এত বছর পরও সেই রেকর্ডের গান দু'টোর চাহিদা রয়েছে৷
এই সময়ের গান কতটা শোনেন? সেগুলি কতটা কালজয়ী হতে পারে বলে মনে হচ্ছে?
এর উত্তর মিলবে অনেক বছর পর৷ তবে আমাদের পরে যাঁরা গান করেছেন, তাঁদের কিছু গান তো থাকবেই৷ যেমন নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম'-এর কথাই ধরুন৷ লোকগানের ক্ষেত্রে স্বপন বসু, গোষ্ঠগোপাল দাসের কথা বলব৷ শুভেন্দু মাইতি, তপন রায় যেমন শিল্পী, তার থেকেও বড় মাপের শিক্ষক৷ আধুনিকে লোপামুদ্রা, শুভমিতা৷ এঁদের গান আমি শুনি৷
এই প্রজন্মের সংগীতচর্চার সার্বিক মান নিয়ে তাহলে আপনি খুশি?
না, কয়েকজন শিল্পীকে বাদ দিলে বাকি ছবিটা কিন্তু তেমন আশাপ্রদ নয়৷ এই যে এত শিল্পী উঠছে, কত দিন টিকবে এরা? নিজস্ব গান নেই, অন্যের গান গাইছে৷ এমনকি নিজস্বতাও নেই৷ ওই যে বললাম, সাধনার অভাব আর চটজলদি খ্যাতি পাওয়ার চেষ্টায় মানের অবনতি হচ্ছে৷ এর মধ্যেও অবশ্য ব্যতিক্রম আছে৷ কালিকা (দোহার-এর কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য) কত ভালো কাজ করছিল, ও আমাদের ছেড়ে চলে গেল৷
তাই কি আপনি এত উদাসীন, নিজেকে গুটিয়ে রেখেছন?
ঠিকই৷ এখনকার এই ব্যাপারগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি না৷ তাই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি৷ এখন আর কোনো অনুষ্ঠানে গান করি না৷ বরং বীরভূমে গানমেলার মতো পার্বণ আয়োজনে একটু সক্রিয় থাকার চেষ্টা করি৷
আজকের এই প্রচারের আলো পেলে আপনার কেমন লাগত?
খারাপ লাগত না৷ কিন্তু গানের সঙ্গে আপস না করে সেটা করতে হতো৷ তাছাড়া আর্থিকভাবেও লাভবান হতাম৷ তখন শিল্পীদের সাম্মানিক সামান্যই ছিল৷ জেলা বেতারে ‘বড়লোকের বিটি' আর ‘বলি ও ননদী' গেয়ে প্রথম ১৫ টাকার চেক পেয়েছিলাম৷ আজকে ভাবা যায়!
এ জন্য কোনো আক্ষেপ...
তা নেই৷ তাই তো পরের জন্মেও আমি শিল্পী হতে চাই৷ সাধনা করে সত্যিকারের শিল্পী৷ মানুষের ভালোবাসা প্রচুর পেয়েছি, ঈশ্বরের আশীর্বাদও৷ তা নিয়ে খেদ নেই৷
সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো আমাদের লিখে জানান, নীচের ঘরে৷