1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রেসক্লাব : সাংবাদিকদের মিলনমেলা, নাকি বিভেদের প্ল্যাটফর্ম?

সমীর কুমার দে ঢাকা
৮ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেকটি বিভাগীয় ও জেলা শহরে একাধিক প্রেসক্লাব। এমনকি উপজেলা পর্যায়েও প্রেসক্লাবের ছড়াছড়ি। প্রেসক্লাবগুলো যেন হয়ে উঠেছে সাংবাদিকদের বিভেদ প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম!

https://p.dw.com/p/4dIuM
প্রেসক্লাব ভবন, বরগুনা
বরগুনা প্রেসক্লাবে আটকে রেখে মারধরের পর এক সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ছবি: Mushfiq Arif

সাংবাদিকদের পেশাগত মান উন্নয়নে প্রেসক্লাবগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। অথচ অধিকাংশ  জায়গায় ‘মূল ধারার' সাংবাদিকরা প্রেসক্লাব সম্পর্কে দৃশ্যত অনাগ্রহী। অনেক ক্ষেত্রেই প্রেসক্লাব খুলে ব্যবসা চালানোর অভিযোগ উঠছে। প্রেসক্লাবের বাইরেও রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাংবাদিক সমিতি, সাংবাদিক ক্লাব, অনলাইন ক্লাবসহ নানা নামে খোলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠান৷

এ প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রেসক্লাব খুলে এখন অনেকেই ধান্দাবাজিতে নেমেছেন। নাম-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকেরা এগুলো করছেন। ঢাকায় যারা কাজ করেন, তাদের অধিকাংশই জাতীয় প্রেসক্লাব বা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সদস্য। ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে এখন প্রেসক্লাব। এদের সঙ্গে মূল ধারার সাংবাদিকদের কোনো সম্পর্ক নেই। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে তারা ক্লাব খুলে বসেছেন। অথচ যারা রেজিষ্ট্রেশন দিচ্ছেন, তাদের এগুলো দেখা উচিত। আবার পত্রিকার হকারও একটা পত্রিকার সম্পাদক-মালিক হয়ে উঠেছেন। জেলা প্রশাসন থেকে তাদের পত্রিকার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু একজন পেশাদার সাংবাদিক পত্রিকার অনুমোদন নিতে গেলে তাকে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। সম্প্রতি প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, যিনি সাবেক বিচারপতিও, তিনি একটি নাম-সর্বস্ব প্রেসক্লাবের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানকার সদস্যদের কাউকে আমরা চিনি না। তার মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির এসব জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত।”

গত শনিবার প্রেসক্লাব দ্বন্দ্বে হামলার শিকার হয়ে শেষে প্রাণ হারিয়েছেন বরগুনার সাংবাদিক তালুকদার মাসউদ। বরগুনায় দু'টি প্রেসক্লাবের একটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সেই প্রেসক্লাবের রেজিষ্ট্রেশনও নিয়েছিলেন যা কিনা বরগুনার পুরোনো প্রেসক্লাবের সদস্যরা মেনে নিতে পারেননি। বিবাদের এক পর্যায়ে প্রেসক্লাবের মধ্যেই তাকে মারধর করা হয়। পরে তিনি মারা যান।

প্রেসক্লাব খুলে এখন অনেকেই ধান্দাবাজিতে নেমেছেন: ফরিদা ইয়াসমিন

সারা দেশের প্রেসক্লাবগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, ঢাকা শহরেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি প্রেসক্লাব। উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, কদমতলিসহ প্রায় সব থানাতেই আছে একটা করে প্রেসক্লাব। এর বাইরে ঢাকা প্রেসক্লাব, মহানগর প্রেসক্লাব নাম দিয়েও খোলা হয়েছে আরো কিছু প্রেসক্লাব। কোনো কোনো থানায় একাধিক প্রেসক্লাবও আছে। যেমন, মিরপুরে দু'টি প্রেসক্লাব। একটি মিরপুর প্রেসক্লাব, আরেকটি বৃহত্তর মিরপুর প্রেসক্লাব। এসব ক্লাবে পরিচিত বা প্রথম সারির দৈনিক বা টেলিভিশন চ্যানেলের কোনো সাংবাদিক নেই। বিভাগীয় শহরগুলোতে খোঁজ নিয়েও মিলেছে প্রতি শহরে একাধিক প্রেসক্লাবের সন্ধান। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ও খুলনায় একটি করে প্রেসক্লাব। সিলেটে দু'টি, বরিশালে ৩টি, রংপুরে দু'টি প্রেসক্লাব আছে। আর রাজশাহী ও ময়মনসিং শহরে আছে ৬টি করে প্রেসক্লাব।

এত বেশি প্রেসক্লাবের ভালো-মন্দ  সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহীর দৈনিক সোনারদেশ-এর সম্পাদক আকবারুল হাসান মিল্লাত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এত বেশি প্রেসক্লাব আমাদের ক্ষতি করছে। রাজশাহীতে আগে থেকেই ছিল তিনটি প্রেসক্লাব। রাজশাহী প্রেসক্লাব হলো এখানকার মূল প্রতিষ্ঠান। এরপর হলো সিটি প্রেসক্লাব, তারপর মেট্টোপলিটন প্রেসক্লাব। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বরেন্দ্র প্রেসক্লাব, সিল্কসিটি প্রেসক্লাব ও মডেল প্রেসক্লাব। এই প্রেসক্লাবগুলোর কোনোটির সঙ্গে এখন আর মূল ধারার সাংবাদিকদের সম্পর্ক নেই। কেউ সেখানে যান না। শুধুমাত্র নাম-সর্বস্ব সাংবাদিকরা এগুলোর সঙ্গে যুক্ত। রাজশাহীতে মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে প্রেসক্লাবের সম্পর্ক উঠে গেছে।”

ময়মনসিংহের চিত্রও একই। সেখানেও ৬টি প্রেসক্লাব। ময়মনসিংহের ‘মূল' প্রেসক্লাব হলো ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব। এখানে আবার সভাপতি পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক। স্বাধীনতার থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। এখনও সেখানে জেলা প্রশাসক সভাপতি। প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক ইত্তেফাকের ময়মনসিংহ ব্যুরো প্রধান মো. মহিউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখানে মূল প্রেসক্লাব একটি। এর বাইরে ‘ভূঁইফোড়' সাংবাদিকরা প্রেসক্লাব ময়মনসিংহ, ডিভিশনাল প্রেসক্লাব, বিভাগীয় প্রেসক্লাব, সিটি প্রেসক্লাব ও মহানগর প্রেসক্লাব নামে আরো ৫টি প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছেন। এগুলোর প্রতিষ্ঠাতা মূলত নাম-সর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকরা। মূল প্রেসক্লাবের সদস্য হতে হলে একজন সাংবাদিককে গ্র্যাজুয়েট হতে হয়। এখানে নাম-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকরা কেউ গ্র্যাজুয়েট নন। ফলে তারা সদস্য পদের আবেদনই করতে পারেন না। এই কারণে তারা নিজেদের স্বার্থে এসব প্রেসক্লাব খুলে বসেছেন।”

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-র সভাপতি ওমর ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এত বেশি প্রেসক্লাব আমাদের পেশার মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে। আমরা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলা সফর করে সাংবাদিকদের একত্রিত করার চেষ্টা করছি। বরগুনায় তো একজন মারা গেছেন। অন্য জায়গাতেও কিন্তু নানা ধরনের গোলমাল হয়েছে। কেউ মারা যায়নি বলে হয়ত আলোচনায় আসেনি। অনেক জায়গায় আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সাংবাদিকদের বিভক্ত করতে স্থানীয় প্রশাসন ভূমিকা রেখেছে। আবার স্থানীয় রাজনীবিদরাও নিজেদের সুবিধার্থে সাংবাদিকদের বিভক্ত করেছেন। এখন আইন পরিবর্তন না হলে নাম-সর্বস্ব পত্রিকার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সাংবাদিক ইউনিয়ন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এই কারণে আইন পরিবর্তনের কথা আমরা বলছি। আবার ঢাকায় যেসব প্রেসক্লাব হয়েছে, সেগুলোতে মূল ধারার কেউ নেই।”

চাঁদাবাজি করতে গিয়ে এখানের অনেক নেতা গণধোলাই খেয়েছেন: জাকির হোসেন

ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাব থাকার পরও কেন মিরপুর প্রেসক্লাব করতে হলো? খবর বাংলাদেশ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক ও মিরপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নাম-সর্বস্ব সাংবাদিকরা আসলেই খারাপ, এই কারণে আমি চলে এসেছি। একবার মিরপুরের উপ-পুলিশ কমিশনার কিছু অবৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেট ধরেছিলেন। ব্রিফিংয়ে তিনি সাংবাদিকদের পরিচয় জানতে চান। তখন ওবায়দুর রহমান নামে একজন বলেন, আমি মিরপুর প্রেসক্লাবের সদস্য। পুলিশ কর্মকর্তা তখন তার কাছে জানতে চান, "কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন?' জবাবে তিনি আবারও বলেন, ‘আমি মিরপুর প্রেসক্লাবের সদস্য। আমরা সবাই সেখান থেকে এসেছি।' এই হলো মিরপুরের সাংবাদিকতার চিত্র।” মিরপুর প্রেসক্লাবের সদস্যরা নাকি চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত? এমন প্রশ্নের জবাবে জাকির হোসেন বলেন, "এখানে যারা আছে, তারা সবাই ধান্দাবাজিতে যুক্ত। চাঁদাবাজি করতে গিয়ে এখানের অনেক নেতা গণধোলাই খেয়েছেন। এরা যে সবাই চাঁদাবাজ এটা একেবারেই সত্যি।”

বরিশালে তিনটি প্রেসক্লাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি ও দৈনিক সমকাল-এর ব্যুরো চিফ পুলক চ্যাটার্জি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আসলে মূল ধারার সাংবাদিকরা মূল প্রেসক্লাবের সঙ্গেই আছেন। কিন্তু যারা নাম-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, তারাই বিভাগীয় ও মেট্টোপলিটন নামে আরো দু'টি প্রেসক্লাব করেছেন। এদের কারণে আসলে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সাংবাদিকতার সম্মান এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।”

রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এসব নাম-সর্বস্ব প্রেসক্লাবের সদস্যদের যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। এরা থানায় এসে বসে থাকে। কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে এলে তাকে তারা টার্গেট করে, নানাভাবে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে- এমন অভিযোগও আমাদের কাছে আসে। আবার নানাজনের পক্ষ নিয়ে তারা সারাদিন তদবির করতে থাকে। তাদের আনাগোনার কারণে আমাদের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম বিঘ্নিত হয়। আবার না করলে তাদের নাম-সর্বস্ব প্রত্রিকায় বা আইপি টিভিতে আমাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিউজ করে মানুষের কাছে বিলি করে। ফলে আমরা খুবই সংকটের মধ্যে কাজ করি।”

দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজশাহী প্রেসক্লাবে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন, পত্রিকা পড়েন ডা. চিন্ময় কান্তি দাস। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "এত বেশি প্রেসক্লাবের কারণে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। আগে যখন সাধারণ মানুষ প্রশাসনের কাছে ন্যায় বিচার পেতেন না তারা প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের বলতেন। এ নিয়ে রিপোর্ট হওয়ার পর ব্যবস্থাও হতো। এখন একজন বিপদে পড়ে কোথায় যাবেন? কোন প্রেসক্লাবে যাবেন? এক প্রেসক্লাবে গেলে আরেক প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ হন। ফলে সাধারণ মানুষ আসলেই বিপদে পড়েন। আমি নিজেও এখন আর কোনো প্রেসক্লাবে যাই না। পাবলিক লাইব্রেরিতে আড্ডা দেই, পত্রিকা পড়ি। এত প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের সম্মান ক্ষুণ্ণ করছে।”

২০১৯ সালের ছবিঘর

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য