প্লাস্টিক দূষণ, মহাসাগরে চরম বিপর্যয়
২৮ জুলাই ২০১৭কাগজ বা কাপড়ের তুলনায় অনেক টেকসই প্লাস্টিক৷ এ কারণেই বিভিন্ন পণ্যের মোড়কে এখনও সবার পছন্দ এই পণ্য৷ কিন্তু এই একই কারণে ‘বন্ধু' প্লাস্টিক এখন পরিণত হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘শত্রু'তে৷
এখন প্লাস্টিক ছাড়া একদিনও কল্পনা করা যায় না৷ কিন্তু ইতিহাস বিবেচনায় প্লাস্টিক একেবারেই নতুন একটি পণ্য৷ ১৯৫০ সালেই পুরো পৃথিবীতে প্লাস্টিকের উৎপাদন ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ টন৷ ৬৫ বছর পর, ২০১৫ সালে সে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৮ মিলিয়ন টনে৷ কল্পনা করা যায়!
পৃথিবীতে এখন প্রতি বছর মাথাপিছু ৬০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার হয়৷ উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং জাপানের মত শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এই পরিমাণ মাথাপিছু ১০০ কেজিরও বেশি৷
বাংলাদেশে এ পরিমাণ বিশ্ব তো বটেই, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায়ও অনেক কম৷ বেসরকারি সংস্থা ওয়েইস্ট কনসার্নের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু ৩ দশমিক ৫ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করেছে৷ শ্রীলঙ্কাতে এই পরিমাণ ৬ কেজি৷ কিন্তু ব্যবহার কম হলে যে বাংলাদেশের ক্ষতিও কম হচ্ছে, তা কিন্তু নয়৷
প্রথমত, অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক খারাপ৷ ফলে প্লাস্টিক, কাঁচ, কাগজ, কাপড় বা পচনশীল দ্রব্য আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনা না করায় অধিকাংশ প্লাস্টিকের মতো অপচনশীল দ্রব্য মিশছে মাটিতে৷
দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতা না থাকায় নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট দ্রব্য ফেলার সংস্কৃতি এখনও বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি৷ ফলে দেশের আনাচেকানাচে বিনাবাধায় ছড়িয়ে পড়ছে প্লাস্টিক৷
তৃতীয়ত, নদী-নালা খাল-বিলের দেশ বাংলাদেশ৷ ফলে পানির অবিরাম প্রবাহ দেশের অধিকাংশ প্লাস্টিক বয়ে নিয়ে ফেলছে সমুদ্রে৷
প্লাস্টিকে ব্যবহার ও ক্ষতি নিয়ে নতুন এক গবেষণা বলছে, ১৯৫০ সাল থেকে অপরিশোধিত তেল দিয়ে তৈরি হয়েছে ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক৷ এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ এখনও বাসাবাড়ি, গাড়ি বা কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে৷ আরো ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে গবেষণায়৷
কিন্তু বাকি ৬০ শতাংশ প্লাস্টিকের হদিস মেলেনি এই গবেষণায়৷ এ হিসেবে মাথাপিছু প্রায় ৬৫০ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক বর্জ্য কোথাও না কোথাও পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে৷ এই ‘কোথাও না কোথাও'-টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহাসগর৷ প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বলছে উৎপাদিত প্লাস্টিকের শতকরা ২ ভাগেরই স্থান হয় মহাসাগরে৷
‘ওয়েইস্ট কনসার্নের' প্রতিবেদন বলছে বাংলাদেশে ৫ লাখ টনেরও বেশি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হয়৷ এর মধ্যে রিসাইকেল হয় মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ৷
প্লাস্টিক বছরের পর বছর পরিবেশে টিকে থাকতে পারে৷ মহাসাগরে ধীরে ধীরে টুকরো টুকরো হয়ে প্লাস্টিকের পণ্য প্রথমে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়৷ পানি ও অন্য খাদ্যের সাথে একসময় এই মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন জীবের দেহে প্রবেশ করে৷ একসময় মাছের সাথে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক যা ঘটায় চরম স্বাস্থ্য বিপর্যয়৷
এছাড়া তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় বেশিরভাগ কাপড়েই সিনথেটিক ফাইবারের ব্যবহারও বেড়েছে৷ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে তৈরি একটি জ্যাকেট একবার ধুলে ১০ লাখেরও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরো মেশে ওয়াশিং মেশিনের পানিতে৷ সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক গবেষণায় দেখা গেছে ওয়াশিং মেশিন থেকে প্রতি বছর ৩০ হাজার টন সিনথেটিক ফাইবার পানিতে মেশে৷
বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ বিভিন্ন পণ্যে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পাটের মতো পচনশীল পণ্যের ব্যবহার উৎসাহিত করছে৷ কিন্তু প্লাস্টিকের ব্যবহার যে হারে ছড়িয়েছে, তাতে এই ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল, বলছেন গবেষকরা৷
বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১২ বিলিয়ন টনে৷ ধেয়ে আসা এই প্লাস্টিক দুর্যোগের ধাক্কা একসময় প্রাকৃতিক উপায়েই কাটিয়ে উঠবে পৃথিবী, কিন্তু মানবজাতি পারবে তো?
কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায় এই দুর্যোগ থেকে? অাপনার মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে৷