ফুটবলের সুরে ফুটবলের ভাষায়
১৪ জুন ২০১৮‘‘আই ফলো দ্য মস্কোভা
ডাউন টু গোর্কি পার্ক
লিসেনিং টু দ্য উইন্ড অব চেঞ্জ
অ্যান অগাস্ট সামার নাইট
সোলজার্স পাসিং বাই
লিসেনিং টু দ্য উইন্ড অব চেঞ্জ''
‘উইন্ড অব চেঞ্জ'– বিখ্যাত জার্মান রক ব্যান্ড ‘স্করপিয়ন্স'-এর সবচেয়ে বিখ্যাত গান৷ নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের কথা লেখা তাতে; ‘সুরে সুরে দিনবদলের আবাহন৷' গানটির কম্পোজার ও গীতিকার ক্লাউস মাইনে তো বেঁচে আছেন এখনো৷ আজ, এই মুহূর্তে যদি রাশিয়ায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি, সুর ঠিক রেখে দু-একটি শব্দ বদলেও তা গাইতে পারতেন৷ ‘চেঞ্জ'-এর জায়গায় 'ফুটবল'৷ ‘অগাস্ট'-এর জায়গায় ‘জুন'৷ ‘সোলজার্স'-এর জায়গায় ‘সাপোর্টার্স৷
ব্যস!
মস্কোভা নদী দিয়ে এগিয়ে গোর্কি পার্ক ধরে গেলে বাতাসে তো কেবল ফুটবলের সুর শোনা যাচ্ছে৷ জুনের গ্রীষ্মের দিন-রাতে তা নিয়েই মাতামাতি৷ পুরো বিশ্ব থেকে আসা সমর্থকরা শুনছে শুধুই ফুটবলের গান৷ আবার যে বিশ্বকাপ ফুটবলের মহাযজ্ঞ শুরু হচ্ছে আজ! চার বছর পর!
মহাকালে চার বছর সময় হয়তো তেমন কিছু নয়৷ কিন্তু ফুটবলপিপাসুদের জন্য এ অপেক্ষা অনন্তকালের৷ সেই কবে ব্রাজিলে হয়েছিল বিশ্বকাপ৷ সে-ই-ই ২০১৪ সালে! আনন্দ-বেদনার কত কাব্য লেখা হয়েছে সেখানে! জার্মানির শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, স্বাগতিক ব্রাজিলের হৃদয়ভাঙার ট্র্যাজেডি উপাখ্যান, লিওনেল মেসির ‘এত কাছে তবু কত দূরে'র আফসোস– আরো কত কী! এরপর থেকেই সবার প্রতীক্ষা ২০১৮ বিশ্বকাপের৷ অনেক হিসেব-নিকেশ চুকাতে হবে যে!
রাশিয়ার অপেক্ষার জায়গাটি ভিন্ন৷ ভ্লাদিমির পুটিনের দেশের জন্য এ এক অন্য রকম চ্যালেঞ্জ৷ বিশ্ব রাজনীতিতে আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশটি৷ অ্যার্মেরিকার প্রপাগান্ডাতে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের কাছেই রাশিয়া এখন বাঁকা চোখে দেখার এক ভূখণ্ড৷ ফুটবলের এই মিলনমেলাতে তাঁরা চায় হারানো সম্মান পুনরুদ্ধার করতে৷ আর সেজন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছে না রাশিয়া ও পুটিন৷
রাশিয়া তাই সেজেছে এখন বিশ্বকাপের সাজে৷ মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়াম যার সবচেয়ে বড় মঞ্চ৷ আজ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি হবে সেখানেই৷ ১৫ জুলাইয়ের ফাইনালও৷ ১১ শহরের ১২ স্টেডিয়ামে হবে বিশ্বকাপের ৬৪ ম্যাচ৷ কিন্তু উত্সবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে মস্কোই৷
আজকের উদ্বোধনী ম্যাচ উপলক্ষ্যে যেমন পুরো রাশিয়া ভেঙে পড়েছে রাজধানীতে৷ পুরো বিশ্বও নয় কী! লুজনিকি স্টেডিয়ামে গিয়ে বুঝেছি তা৷ আরো বেশি করে রেড স্কয়ার, বলশোয়ি থিয়েটার, কার্ল মার্কস চত্বরে ঘুরে৷ কোন দেশের সমর্থক নেই সেখানে! লিওনেল মেসির ছবি আঁকা বিশাল ব্যানার নিয়ে উল্লাস আর্জেন্টাইনদের৷ ব্রাজিলিয়ানদের সোনালি জার্সির রং যেন সকালের সূর্যের ঔজ্জ্বল্যকেও হার মানাচ্ছে৷ ইংল্যান্ডের সমর্থকদের দেখেছি রাতে বিয়ারের ক্যান হাতে হেঁড়ে গলায় ফুটবলের গান গাইতে৷ জার্মানদের চেহারায় শিরোপা ধরে রাখার প্রতিজ্ঞা৷
ট্রফি জয়ের সম্ভাবনা নেই যেসব দলের, উল্লাসে তারাও পিছিয়ে নেই৷ সৌদি আরবের সমর্থকদের বিশাল বহর মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় জানান দিচ্ছেন নিজেদের উপস্থিতি৷ পেরুর লাল জার্সি চোখে পড়ছে চোখ মেললেই৷ ইরানের সমর্থকরা গান গাইছেন নিজেদের মতো৷ যেমনটা মিশরেরও৷ নিজেদের ভাষায় গাওয়া সেই গানের তরজমাও করে দেন বুকে প্রিয় খেলোয়াড়ের ছবি আঁকা জার্সির তরুণ আবদুল্লাহ বালেগ, ‘সালাহ এখন মিশরের রাজা'৷
আর রাশিয়া? তাঁরা জানেন, নিজেদের দলের ফুটবলের সম্ভাবনা নিয়ে৷ জানেন, প্রথম রাউন্ড পেরোনোই কঠিন স্বাগতিকদের৷ উরুগুয়ে, সৌদি আরব ও মিশরের সঙ্গে ‘এ' গ্রুপে তাঁরা৷ ‘‘মাঠের ফুটবলে আমরা হয়তো পিছিয়ে৷ কিন্তু আতিথেয়তায় আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে না কোনো দেশ৷ নিশ্চিত থাকতে পারেন, সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ হবে এটি,'' বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণী আনাতোলিয়ার ঘোষণা৷
সর্বকালের সেরা হোক বা না হোক, আয়োজক হিসেবে রাশিয়া পাস মার্ক পাবে কিনা, সেটি জানতে অপেক্ষা করতে হবে এক মাস৷ বিশ্ব ফুটবলের নতুন রাজত্বের অভিষেকের জন্যও৷ অবশ্য পুরনো রাজা জার্মানিও রাজত্ব ধরে রাখতে পারে৷ ইওয়াখিম ল্যোভের দলের ভেতর সে প্রতিশ্রুতি রয়েছে ভালোমতোই৷
ব্রাজিলের জন্য ‘মিনেইরাজো' দুঃস্বপ্ন ভোলার মিশন এটি৷ লিওনার্দো বাক্কি তিতের দল তৈরি৷ বাছাইপর্বে দুর্দান্ত খেলেছে, প্রস্তুতিও জম্পেশ৷ আশঙ্কা ছিল যে নেইমারকে নিয়ে, দুটো প্রস্তুতি ম্যাচে দুই গোল করে নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন৷ ফেব্রুয়ারিতে যে ইনজুরিতে পড়েছিলেন, তা থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠার ঘোষণা তাতে৷ তুলনায় মেসির আর্জেন্টিনা সম্ভাবনার অঙ্কে পিছিয়ে খানিকটা৷ বাছাইপর্বের মাঝপথে কোচ বদল করে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে হোর্হে সাম্পাওলিকে৷ শেষ ম্যাচের মেসির হ্যাটট্রিকে ভর করে তবেই বিশ্বকাপের টিকেট পেয়েছে দলটি৷ এদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচটিও ভন্ডুল হয়ে গেছে নানা বিতর্কে৷ তবু একজন মেসি যখন রয়েছেন, তখন '৮৬ ফেরানোর স্বপ্ন দেখতেই পারে আর্জেন্টিনা৷
একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর জন্য যে স্বপ্ন দেখছে পর্তুগালও৷ কেউ তাঁদের গোনায় ধরছে না সত্যি, কিন্তু দলটি যে ইউরোর বর্তমান চ্যাম্পিয়ন, তা-ও তো মিথ্যে নয়৷ ২০১৬ ইউরোর সে আসরে ফাইনালে হেরেছিল ফ্রান্স৷ এবার আরো পরিণত, আরো শানিত হয়ে '৯৮ ফেরাতে চায় তাঁরা৷ নিজেদের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের মুকুটে দ্বিতীয় পালক যোগ করার সুযোগ স্পেনের সামনেও৷ কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক আগে আগে কোচ খুলেন লোপেতেগিকে বরখাস্ত করায় টালমাটাল স্প্যানিশ ক্যাম্প৷
শিরোপা যে দলই জিতুক না কেন, বিশ্বকাপের মাতাল হাওয়া বইছে এখন পুরো বিশ্বে৷ সে হাওয়ার তোড় সবচেয়ে বেশি নিঃসন্দেহে রাশিয়াতেই৷ নিজেদের উঠোনে পুরো বিশ্বকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত তাঁরা৷ দিন কয়েক এখানে থাকার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কী প্রবল ভাষাগত সমস্যা৷ রুশ ভাষা ছাড়া অন্য কিছু বোঝার লোক খুবই কম৷ তাতে কী! এক মাসের এই বিশ্বকাপ মহাযজ্ঞের ভাষা তো একটাই৷ ফুটবল৷
ফুটবলের ভাষাতেই তাই সামনের এক মাস কথা বলবে পুরো বিশ্ব৷ স্করপিয়ন্সের ‘উইন্ড অব চেঞ্জ' গানটির কথা খানিকটা বদলে সুরে সুরে ভাঁজবে সবাই৷ সবাই, মানে ৭০০ কোটি মানুষের সবুজ এই গ্রহের সব্বাই!