বন্ধ হোক রং ফর্সার প্রতারণা
৩ মার্চ ২০২০শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান পারদ এবং হাইড্রোকুইনোন দিয়ে প্রস্তুত এইসব রং ফর্সাকারী ক্রিম মেখে কালো মেয়েরাও আজ সাফল্যের শীর্ষে! অন্তত রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন তো তাই বলে৷
বাজারে এরকম রং ফর্সাকারী ক্রিমের সংখ্যা শতাধিক৷ সেগুলোর কিছু বিউটি পার্লারগুলোতে খানিকটা গোপনে আর কয়েকটি রীতিমতো তারকাদের দিয়ে গুণগানের বিজ্ঞাপন প্রচার করে বিক্রি হচ্ছে৷ শুধু মেয়ে কেন বলছি, রং ফর্সার চেষ্টার এই দলে ছেলেরাও আছে৷
আমাদের পরিবার ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা এই ‘বর্ণবাদ’-এর কারণে সব জেনে বুঝেও রং ফর্সার ফাঁদে পা দিয়ে বিপজ্জনক উপাদান দিয়ে তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে মানুষ নিজের সর্বনাশ করছে৷
মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকায় সোমবার বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানে উৎপাদিত রং ফর্সাকারী আটটি ক্রিমের বিপণন নিষিদ্ধ করেছে৷
বিএসটিআই-এর মান নিয়ন্ত্রণ (সিএম) বিভাগের সহকারী পরিচালক আবু হানিফ বলেছেন, ‘‘এসব পণ্য আমদানি, খোলা বাজার কিংবা অনলাইনে বিপণনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো৷ পরবর্তীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে৷’’
ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও ‘ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট’-এ সংশোধন করে রং ফর্সাকারী ক্রিমের মতো জাদুকরী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে৷
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় গত ৩ ফেব্রুয়ারি লোকসভায় এ সংক্রান্ত একটি খসড়া বিল প্রস্তাব করে৷ বিলে এমন পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রথমবার ধরা পড়লে ১০ লাখ রুপি জরিমানা বা দুই বছরের কারাদণ্ডের কথা বলা রয়েছে৷ দ্বিতীয়বার ধরা পড়লে সেই শাস্তি হবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ লাখ রুপি পর্যন্ত জরিমানা৷
বাংলাদেশেও এ ধরনের আইন প্রয়োজন৷ শুধু পণ্য নিষিদ্ধ করে কার্যত তেমন কোনো ফল পাওয়া যাবে না৷ কারণ, বিভিন্ন নামে নানা দেশ থেকে বৈধ-অবৈধ সব পথে রং ফর্সাকারী ক্রিমে বাজার সয়লাব৷ দুই-একটি ক্রিম নিষিদ্ধ করে ফর্সা হওয়ার এই ভূত কাঁধ থেকে নামানো যাবে না৷
একই সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ রং ফর্সাকারী ক্রিমের চাহিদা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতেই বেশি৷
বিবিসির ২০১৭ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে রং ফর্সাকারী ক্রিমের প্রায় ৪৮০ কোটি ডলারের বাজার রয়েছে৷ ২০২৭ সাল নাগাদ তা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হবে৷
এসব রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করে ত্বকে চুলকানি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া, ফুসকুড়ি এমনকি ত্বক স্থায়ীভাবে পুড়ে যেতে পারে৷ নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভের সন্তানের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও রয়েছে৷
এমন ক্রিম যারা ব্যবহার করেন তাদের অনেকে ‘শিক্ষিত’ এবং বিপদের ঝুঁকি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল৷ তারপরও কেন তারা এসব ক্রিমের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন?
আমাদের সমাজে কালো মানেই ‘খারাপ’৷ বিয়ের পাত্রী নির্বাচনের সময় সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হয়ে যায় ফর্সা রং৷ কর্মক্ষেত্রেও ফর্সা মেয়েটি এখনো খানিকটা এগিয়ে থাকে৷
কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটিকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয় রং ‘ময়লা’৷ তাই কালো থেকে ‘শ্যাম’ বা ‘উজ্জ্বল শ্যাম’ বর্ণের হতে তার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা!
আজকাল কন্যা সন্তানের জন্ম নিয়ে আগের মতো আর আক্ষেপ করেন না বাবা-মা৷ তবে মনে মনে কামনা করেন, মেয়ে হবে ফর্সা, কিংবা সমাজের ভাষায় ‘সুন্দর’৷ গর্ভের সন্তানের রং ফর্সা করতে মুরব্বিদের কত কি উপদেশ!
সমাজের এই বদ্ধমূল ধারণাকে পুঁজি করেই রং ফর্সাকারী ক্রিমের বাজার এত রমরমা৷ এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের মনের গভীরে রোপিত এই বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে হবে৷
এ কাজ শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই৷ বাবা-মাকে তার সন্তানের গায়ের রং নিয়ে দুশ্চিন্তা বন্ধ করতে হবে৷ তাহলে বড় হয়ে সন্তানও ওই চাপ থেকে মুক্তি পাবে৷ বিয়ের সময় ফর্সা পাত্রী খোঁজা বন্ধ হবে; কর্মক্ষেত্রে হবে যোগ্যতার বিচার৷ সমাজ ও রাষ্ট্রে আসবে পরিবর্তন৷ রং ফর্সার প্রতারণার ফাঁদে নিজের স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলতে হবে না৷ আসুন নিজেকে ভালোবাসি৷