বন্যার কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থী
২১ আগস্ট ২০২২এক বছর আগের ঘটনা৷ ভোলা জেলার রামদাসপুর গ্রাম৷ মেঘনা নদী যখন প্রমত্তা হয়ে উঠেছিল তখন মোহাম্মদ জুয়েল এবং আরজু বেগম টিনের ঘরের চালে বসে রাত কাটিয়েছেন৷ তখনই সিদ্ধান্ত নেন আর এখানে নয়৷ পরদিন চার সন্তানকে নিয়ে পূর্বপুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে তারা চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়৷
কেবল রামদাসপুর গ্রাম নয়, ভোলার বেশিরভাগ গ্রামের মানুষের অবস্থাই জুয়েলদের মত৷ জুয়েল সংবাদ সংস্থা এপিকে জানান, ‘‘আমরা এই নদীতীরেই বড় হয়েছি৷ মাছ ধরেছি এই নদীতে৷ অথচ এই নদী আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে৷ এই গ্রামে আমার জন্ম৷ গ্রামের জন্য মন কাঁদে৷ কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না৷''
বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ১৩০টি নদী৷ এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বন্যাপ্রবণ৷বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের আবহাওয়া অপ্রত্যাশিত আচরণ করছে৷ এর ফলে প্রায়ই নদী ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাচ্ছে৷ জুন থেকে অক্টোবর বাংলাদেশে বর্ষাকাল৷ এ সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা৷ এর ফলে নদী তীরে থাকা বাজার, স্কুল, মসজিদ, ঘর-বাড়ি পানিতে ভেসে যায়৷ ফলে লাখো মানুষের গৃহহীন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়৷ অনেকেই পরিণত হন ‘জলবায়ু শরণার্থীতে'৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কেবল বন্যা নয়, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন এবং অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি মাটিতে প্রবেশ করার কারণেও বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা৷
বিশ্ব ব্যাংকের গত বছরের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে যে হারে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে চলে আসবে দেশটি৷ অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সংখ্যার দিক দিয়ে এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে চলে যাবে৷
ঠিক একবছর পর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছিলেন জুয়েল৷ তখন দেখলেন কেবল তাদের বাড়ি নয়, আরও অনেক বাড়ি মেঘনাগর্ভে বিলীন হয়েছে৷ এই গ্রামে একসময় অনেক ছোট মুদী দোকান, চায়ের দোকান, বাজার বসত৷ চারপাশটা সবুজে ঘেরা ছিল৷ এখানকার মাটি ছিল বেশ উর্বর৷ কিন্তু বছরের পর বছর বন্যা আর নদী ভাঙনের কারণে এখানকার জনবসতি হ্রাস পেয়েছে৷ আগে যেখানে দুই হাজার মানুষের বাস ছিলো, এখন মাত্র ৫০০ মানুষ এখানে থাকে৷
আরজু বেগম বলেন, ‘‘আমি যখন ঘরের কাজ করতাম, আমার বাচ্চাকে ঘরের খুঁটির সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতাম, যাতে পানিতে পড়ে না যায়৷ আমাদের বাড়ি আশপাশে যারা ছিলো তারা এখন রাস্তায় বা ভাড়া বাড়িতে থাকে৷ কেউবা বাঁধের পাশে তাবু বানিয়ে অস্থায়ীভাবে থাকছে৷ আমরা ঢাকায় থাকি এখন৷ নিজেদের বাড়ি বলতে আর কিছুই নেই৷ আমরা এখন উদ্বাস্তু৷''
ঢাকার উত্তরেজলবায়ু শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়েছে সরকার৷ চেষ্টা করছে সেখানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের৷ কিন্তু জুয়েলের ভাগ্যে সেই সুবিধা জোটেনি৷ মিরপুরের একটি বস্তিতে ছোট একটি ঘরে জুয়েল তার পরিবার নিয়ে থাকেন৷ এই শহরে মানিয়ে নিতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘আমাদের নিজের বাড়ি ছিলো, ভাড়া গুণতে হয়নি কখনো৷ মাসে যা আয় হয় তা খুব সীমিত, যা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন৷''
জুয়েল এখন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করেন, মাসে ১২ হাজার টাকা পান৷ আর তার স্ত্রী দুই বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে চার হাজার টাকা পান৷ চার হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে বাকিটা অন্যান্য খরচে ব্যয় হয়৷
জুয়েল চান তার সন্তানরা ভালোভাবে মানুষ হোক৷ ভালো স্কুলে পড়ালেখা করুক৷ কিন্তু সবকিছু তার কাছে অসম্ভব মনে হয়, তার কাছে এখন টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা৷
এপিবি/আরকেসি (এপি)