বাংলা সাহিত্যে ঝড়
২৩ এপ্রিল ২০১৮বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রায়ই ঝড়ের মুখোমুখি হতে হতো৷ ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়ার এতরকমভাবে ঝড়ের অবতারণা করতেন যে, পরীক্ষার খাতায় সে সব ঝড়ের বড়ই কাঠকাঠ বর্ণনা করতে হত৷ সত্যি বলতে, টেমপেস্ট, কিং লিয়ার, পেরিক্লিসের ঝড় কোনোদিন অনুভব করতে পারিনি৷ নদীমাতৃক বাংলায় সমুদ্রের ঝড় কোনোদিন দেখা হবে কি করে? তাই যাহা দেখি নাই তাহার সরস বর্ণনা কেমনে করিব?
পরবর্তীকালে রবি জীবনী পড়তে গিয়ে দেখলাম তিনি এই ইংরেজের থেকে অনুপ্রাণিত৷ বাল্যবয়সে তিনি ম্যাকবেথের সেই তিন ডাইনির নাচকে সুন্দর বাংলায় অনুবাদ করেছেন, আমি ‘ঝড় বাদলের রাতে' ওদের নাচ যেন দেখতেই পেয়েছি৷ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসাহিত্যে ঝড় যতবার পেয়েছি, ওই তিন ডাইনির নাচ ভুলতে পারিনি৷ তবে সবার আগে স্বীকার করতে হয় যে ‘দেবতার গ্রাস'-এর ঝড় সব বাঙালিরই মনকে নাড়া দিয়েছিল৷ নজরুলের কবিতায় বা মোহিতলাল মজুমদারের কবিতায় কালবৈশাখী বড়ই তাণ্ডব করে৷ সে ঝড় সংহারক, রুদ্র৷ ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে অদ্বৈত মল্ল বর্মণ লিখেছিলেন, ‘‘কোনো রাতে ঝড় আরম্ভ হইলে সহজে কমিতে চায় না৷ সারারাত্রি চলে পাপসংহার৷ কোনো কোনো সময় প্রতি রাতে ঝড় আসে৷ সারাদিন খায় দায়, সন্ধ্যার দিকে আসন্ন ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হয়৷ ঈশান কোণের কালো মেঘ সারা আকাশে ধোঁয়ার মতো ছড়াইয়া গিয়া হু হু করিয়া বাতাসে আসে৷ তারপর আসে ঝড়৷''
বাংলার ঝড় দেখার সৌভাগ্য অল্পবিস্তর সকলেরই আছে৷ বাংলার একান্ত আপন কালবৈশাখীর কথা বলছি৷ যে ঝড়ে আম পড়ে, অপু দুর্গার মতো সব গ্রাম্য বাঙালি সে আম কুড়ায় বা শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে৷ বাংলার দুর্যোগ মানেই ঝড়বৃষ্টি৷ কস্মিনকালেও টাইফুন, টর্নেডো পথ ভুল করে এ বাংলায় আসেনি৷ ইদানীংকালের সুনামি বা আয়লার কথা আলাদা৷ বাংলার ঝড়ে পথ হারানোর সুযোগ হয়৷ আর একপশলা বৃষ্টি হতেই হবে৷ তাকেই সঙ্গত করবে ঝড়৷ নইলে বালিকা রাধারানি হারাবেই বা কেমন করে আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখবেনই বা কেমন করে? ‘কপালকু্ন্ডলা' শুরুর আগে ভূমিকাতে তিনি সেই শেক্সপিয়ারের কাছে ফিরে গিয়েছেন৷ নইলে কি গঙ্গাসাগরে নবকুমার পথ হারাতে পারতেন? শেক্সপিয়ারের ‘কমেডি অফ এররস্'-এর অনুবাদ ‘ভ্রান্তিবিলাস'-এও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র ঝড়ের বর্ণনা বিন্দুমাত্র কম করেননি৷
বাংলার সাহিত্যিকরা ঝড় বাদলের মধ্যে দিয়ে বাংলার মানুষের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তাতে শুধু জীবিকা নয়, জীবনযাত্রাও পরিষ্কার হয়েছে৷ শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে তাই ঝড়ের অন্য রূপ৷ ‘পদ্মা নদীর মাঝি'-তে তাই নদীর বুকে ঝড়ের অন্য বর্ণনা৷ ‘একদিন প্রবল ঝড় হইয়া গেল৷ কালবৈশাখী কোথায় লাগে৷ সারাদিন টিপিটিপি বৃষ্টি হইল৷ সন্ধ্যায় আকাশ ভরিয়া আসিল নিবিড় কালো মেঘে, মাঝরাতে শুরু হইল ঝড়৷'
ঝড় বাদলপূর্ণ দুর্যোগের সঙ্গে অশরীরী সত্তার যে নিবিড় যোগ, তা বহু শতক আগেই কোলরিজ সাহেব স্থির করে দিয়েছিলেন৷ সেই নাবিক আর অ্যালবাট্রসের মায়াবি কল্পলোকে সমুদ্রঝড়ের এমন বর্ণনা আসলে ঝড়ের অতিপ্রাকৃত রূপকেই তুলে ধরেছিল৷ তাই হয়ত পরের দিকে বঙ্গদেশের সাহিত্যে সহজেই ঝড়কে অতিপ্রাকৃত পরিস্থিতি তৈরির সঠিক রূপকার বলে মেনে নেওয়া সহজ হয়েছিল৷ ঝড় বাদলের রাত যেমন বাংলা সাহিত্যে রোম্যান্টিক আবহ তৈরি করেছে, তেমনই বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আধিভৌতিক পরিস্থিতিরও জন্ম দিয়েছে৷ সেই পরিস্থিতিতে জাগতিক, অতিজাগতিক এমনকি মহাজাগতিক চরিত্ররাও বাংলা সাহিত্যে হাজির হয়েছে৷ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পে অন্য গ্রহের প্রাণীরা এসে আমাদের পৃথিবীতে আক্ষরিক অর্থে ঝড় তুলতে পারে৷ আবার অষ্টমীর দুর্যোগপূর্ণ রাতে কে যেন বেহালা বাজায়! হ্যাঁ, ত্রৈলোক্যনাথের ‘পূজার ভূত' বাংলা ভাষায় সেই সর্বপ্রথম সার্থক ভূতের গল্প হাজির করেছিল৷ ‘যখনই রাত্রিকালে বাদলা ও দুর্যোগ হয়, তখনই বাহির বাড়ীতে কে যেন প্রাণপনে বেহালা বাজায়৷' ত্রৈলোক্যনাথের পর বাংলায় বিভিন্ন সাহিত্যিক ওই পথে হেঁটে সফল হয়েছেন৷ সে তালিকায় প্রেমেন্দ্র মিত্র, শরদিন্দু কে নেই! তাই সেই দীর্ঘ ইতিহাসে ঢোকা ঠিক হবে না৷
কালবৈশাখী বাঙালির রক্তে রক্তে৷ তাই বাঙালি সাহিত্যিক-ভ্রামণিকদের যাত্রাপথে বিভিন্ন সময়ে কালবৈশাখীর অনুষঙ্গ এসেছে৷ এমনকি সুদূর কাবলিওয়ালার দেশেও সৈয়দ মুজতবা আলী দিনের উত্তাপের সঙ্গে কালবৈশাখীর তুলনা টেনেছেন, ‘....আসলে যেমন কালবৈশাখী বিপজ্জনক হলেও তার সঙ্গে দিনের পর দিন ১১২ ডিগ্রির অত্যাচারের তুলনা হয় না, তেমনি বরফের ঝড়ের চেয়েও মারাত্মক দিনের পর দিন ১০ ডিগ্রীর অত্যাচার৷'
আবার বুদ্ধদেব বসু লিখছেন, ‘কলকাতার লোকের কাছে কালবৈশাখী কিছু নয় কিন্তু একজন অস্ট্রিয়ানের কাছে এ নিশ্চয়ই এক অভিজ্ঞতার মতো অভিজ্ঞতা৷ ধুলোর ঝড়, নারকোল গাছগুলোর মাথা নাড়ানো, মেঘের গুরু গুরু, আকাশের কালো কুটিল রূপ, বিদ্যুতের ঝিলিক; বাজের শব্দ৷'
বাঙালি যে তার একান্ত আপন ঝড়টিকে নিয়ে যারপরনাই রোম্যান্টিক তাতে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই৷ নইলে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখলেন কী করে –
‘ঝড় যেমন করে জানে অরণ্যকে
তেমনি করে তোমায় আমি জানি৷'
রবি ঠাকুরও এ দলে যে নাম লিখিয়েছেন, তার নমুনাও ভুরি ভুরি —
‘ঝড় বহে মনে হয়, ও যেন রে ঝড় নয়,
অন্ধকার দুলিছে কাঁপিয়া৷'
শরৎচন্দ্র লেখেন, ‘…তবে রাক্ষসী সাতশ' নয়, শতকোটি; উন্মত্ত কোলাহলে এদিকেই ছুটিয়া আসিতেছে৷ আসিয়াও পড়িল৷ রাক্ষসী নয় — ঝড়৷ তবে এর চেয়ে বোধ করি তাদের আসাই ঢের ভালো ছিল৷'
বাঙালির জীবনে অবশ্য ঝড় কম নয়৷ বাঙালির রাজনীতি থেকে চায়ের কাপ — ঝড় তোলার অভ্যেসটা সর্বত্র৷ নজরুল থেকে সুকান্ত – সে তালিকাও কিঞ্চিৎ লম্বা বৈকি!
‘নাচে ঐ কাল-বোশেখী, কাটাবি কাল বসে কি?'
এবং
‘ঝড় আসছে — সেই ঝড়;
যে ঝড় পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জালদের টেনে তুলবে৷
আর হুঁশিয়ার মজুর;
সে ঝড় প্রায় মুখোমুখি৷'
আবার বাঙালির প্রেমে পড়াটাও কোনো অংশে দুর্ঘটনার থেকে কম নয়, ঝড়ের চাইতেও কম নয়৷ তাই কালবৈশাখীর মাস চৈত্রমাসেই ‘তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ'৷
এ যুগে মন্দাক্রান্ত সেনও লেখেন,
‘ধূসর পাঞ্জাবি মেঘলা পাঞ্জাবি তোমার পাঞ্জাবি
মেঘ নামায়
এখনই রোদ ছিল, লজ্জাবোধ ছিল, হঠাৎ ঝড় এল
আকাঙ্খায়….'
সব মিলিয়ে বাংলার ঝড় একান্ত আপন৷ তার রুদ্র সংহারক মূর্তি ভুলিয়ে দিয়ে বারবার সে বাঙালির প্রাণের দোসর হয়ে ওঠে৷ ইংরেজি সাহিত্যের সমুদ্রঝড়, বরফ ঝড় আমার আজও কল্পনা করতে কষ্টই হয়৷ বরং গাজনের উল্লাসে ধেয়ে আসা কালবৈশাখী নিয়ে তাই বেশিই বলে ফেলি৷ আজও বলে ফেললাম৷
‘নববর্ষের পুণ্য-বাসরে কাল-বৈশাখী আসে,
হোক সে ভীষণ, ভয় ভুলে যাই অদ্ভুত উল্লাসে৷'
ঝড় নিয়ে কোন গল্প, কবিতা বা উপন্যাসটি আপনার মনে পড়ে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷