‘বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থার উত্থান’
১৮ এপ্রিল ২০১৮প্রায় ৪২ মিনিটের তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ভ্রমণ করেছে ডয়চে ভেলের টিম৷ কথা বলেছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নিহত ব্লগারদের পরিবার, তরুণ সংস্কৃতিকর্মী, নারী ব্লগার, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আক্রান্ত সংখ্যালঘু পরিবার, সাধারণ মানুষ ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে৷
তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকার ও বিরোধীপক্ষের বাদানুবাদ প্রসঙ্গ, রোহিঙ্গাদের একাংশের জঙ্গিবাদে জড়ানোর শঙ্কা ও কট্টর ইসলামপন্থিরা নারীদের কীভাবে দমিয়ে রাখতে চায়, সেইসব প্রসঙ্গ৷
তথ্যচিত্রের শুরুতে এক নারী ব্লগার আয়েশা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, বাংলাদেশ কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকছে৷ এ থেকে বেরুতে হলে দরকার প্রকৃত শিক্ষা৷''
নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায় রাজনৈতিক অনৈক্য ও অসহিষ্ণুতাকেই দায়ী করেন যে কোনো ধরনের উগ্রপন্থার জন্য৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের নেতারা সঠিক রাজনৈতিক চর্চা করেন না৷ আমরা একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছি৷ যদি এটা চলতেই থাকে, তাহলে বাংলাদেশে একটি নৈরাজ্যমূলক পরিবেশ তৈরি হবে৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘হয় কর্তৃপক্ষ অসমর্থ ও অদক্ষ, অথবা তাঁরা এর বিচার করতে চান না৷ বিচারহীনতার আর কী ব্যাখ্যা আছে?''
তথ্যচিত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি পাকিস্তানের মতো নয়৷ এ দেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও বলে৷ প্রশ্ন করা হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে সরকার? প্রশ্নটি করা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে৷
তিনি এর উত্তরে বলেন, ‘‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার ‘জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করেছে৷ আমরা কোনো রকমের জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদকে সহ্য করিনি৷ ভবিষ্যতেও করব না৷''
তাহলে কেন ব্লগাররা মারা গেলেন, তার উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘দেখুন এ দেশের মানুষ সাধারণভাবে ধর্মপরায়ণ৷ কেউ কেউ অবশ্য কট্টরপন্থি৷ তাই যখন আপনি কোরানকে বিকৃত করেন কিংবা মহানবীকে কটাক্ষ করেন, তখন অনেকে আঘাতপ্রাপ্ত হন৷ তাঁরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এসব করেন৷ এভাবেই ব্লগাররা নিজেদের ওপর বিপদ ডেকে এনেছেন৷''
তাঁর মতে, যারা বিকৃত করেন, এবং যারা হত্যা করেন, উভয়ই উগ্রপন্থি৷ এইচ টি ইমাম আরো বলেন, ‘‘দু'পক্ষকেই মূল ধারায় আনতে হবে৷''
তথ্যচিত্র দলটি লালবাগের একটি মাদ্রাসায় যায়৷ সেখানে কথা বলে হেফাজতে ইসলামেরনেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ'র সঙ্গে৷ তিনি বলেন, ‘‘ইসলাম একটি উদার ও মধ্যপন্থি ধর্ম৷ অন্যান্য ধর্ম, যেমন, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সবার মাঝেই সন্ত্রাসী আছে৷ কিন্তু যখনই ইসলাম ধর্মের কেউ কোনো অন্যায় করে, এর সঙ্গে ইসলামকে জড়িয়ে দেয়া হয়৷ সেটা অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে কিন্তু হয় না৷''
তিনি মনে করেন, ইসলামকে বা নবীকে কটাক্ষ করা হলে, মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়৷ কিন্তু সে জন্য অস্ত্র তুলে নেয়াকে সমর্থন করেন না তিনি৷ তবে তিনি মনে করেন, সেজন্য বিচার চাওয়ার অধিকার তাঁদের আছে৷
সংবিধানে লেখা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারণা থেকে বাংলাদেশ ক্রমশ দূরে সরছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সারা হোসেন৷ তবে মূল সমস্যা ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা বলেই মনে করেন তিনি৷
তাঁর কথায়, ‘‘যারা অসহিষ্ণু, সমাজে তাদের সহ্য করার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে৷ অন্যদিকে, যতক্ষণ আমার বক্তব্যের সমর্থন পাচ্ছি, ততক্ষণই কেবল আমি ভালো৷ কিন্তু সেই আমিই অন্যের মতকে সম্মান করছি না৷''
তথ্যচিত্র দল এরপর নোয়াখালীর আলাদিন নগর গ্রামে যায়৷ সেখানে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা হয়৷ সেই গ্রামের এক তরুণ জানান, আশেপাশের মুসলিম পরিবারগুলোই তখন তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়েছে৷ অনেকে তাঁকে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বললেও তিনি দেশত্যাগ না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কারণ, এটাই তাঁর দেশ৷
তথ্যচিত্র দল এছাড়াও কথা বলেছে হাটহাজারি মাদ্রাসার হেফাজত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে৷ হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফির পুত্র মাওলানা আনাস মাদানি বলেন, ‘‘ইসলামি শিক্ষা মানে অন্যকে কষ্ট দেয়া বা মেরে ফেলা নয়৷ ইসলাম শান্তির শিক্ষা দেয়৷ এখান থেকে পাশ করে শিক্ষার্থীরা সমাজের নানা উন্নয়নের কাজ করবে৷''
সংগঠনটির একজন মুখপাত্র মুফতি সারোয়ার বলেন, ‘‘আমরা নারী শিক্ষার জন্য অনেক কাজ করেছি৷ আমরা নারীকে দেশের উন্নয়ন, হস্তশিল্প, সন্তান লালনপালন, সংসারের কাজকর্ম, স্বামীর প্রতি আনুগত্য, প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ এসব শিক্ষা দিয়ে থাকি৷''
তথ্যচিত্রের শেষ দিকে দলটি যায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যম্পে৷ সেখানে তাঁরা কথা বলেন কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে৷ তথ্যচিত্রে বলা হয়, মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে কেউ কেউ জিহাদের ঘোষণা দিয়েছেন৷ তাই এখান থেকে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে৷
সদ্য কৈশোর পেরোনো কয়েকজন তরুণের একটি ব্যান্ড দলকেও দেখানো হয়েছে, যারা বাংলাদেশে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ঘটনাগুলো দেখে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীত৷ কিন্তু তাঁরা এসব ধারণার বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই চালিয়ে যেতে চান৷
এসব বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তথ্যচিত্রে বলেন, ‘‘কিছু হলেই সরকার আমাদের ওপর দোষ চাপায়৷ একটা গরু মারা গেলেও বলে বিএনপির কারণে মরেছে৷ যদি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া না থাকে, তাহলে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেবেই৷''
সব মিলিয়ে তথ্যচিত্রটিতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, জঙ্গি হামলা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নারীদের অবস্থা এসবের একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে৷
মঙ্গলবার জার্মানির রাজধানী বার্লিনে জার্মানির অন্যতম টেলিভিশন চ্যানেল এআরডি-র কনফারেন্স রুমে তথ্যচিত্রটি প্রদর্শিত হয়৷ জার্মানির অন্যান্য মিডিয়া হাউসের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডয়চে ভেলের পরিচালক পেটার লিমবুর্গ স্বয়ং৷ তাঁর সঙ্গে আলোচনা সভায় অংশ নেন তথ্যচিত্র নির্মাতা সান্দ্রা পেটার্সমান ও ক্রিস্টিয়ান ওস্টারমান, ডয়চে ভেলের এশিয়া বিভাগের প্রধান আলেকজান্ডার ফ্রয়েন্ড এবং বাংলা বিভাগের প্রধান দেবারতি গুহ৷
জেডএ/এসিবি
ডকুমেন্ট্রিটা দেখলেন? আমরা এ বিষয়ে আপনাদের মতামত জানতে আগ্রহী৷ তাই লিখুন নীচের ঘরে৷