বাংলাদেশে জ্বালানি ছাড়াই চলছে প্রাকৃতিক হিমাগার
১৬ অক্টোবর ২০১৮বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসবিহীন প্রাকৃতিক শস্য সংরক্ষণাগারের কথা ভাবা যায়? এমন এক প্রাকৃতিক হিমাগার থাকলে কেমন হবে? বাস্তবে তেমনি এক সংরক্ষণাগার তৈরি করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এম. মনজুর হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘২০১২ সালে যখন এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়, তখন থেকে আমরা দুই বছর ধরে এটা নিয়ে ভেবেছি৷ এরপর স্টোরেজটা আমরা এমনভাবে বানালাম, যার মাঝখানে পানি, দুই দিকে দেয়াল৷ এবং একটা দেয়াল থেকে ইভাপোরেশন হয় এবং এতে ঘরটা যথেষ্ট কমফোর্টেবল হয়৷ এভাবেই আমরা একটা প্রোটোটাইপ বানালাম, যেটা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই৷''
মূলত ভারনাকুলার আর্কিটেকচার পদ্ধতির মাধ্যমে প্রকল্পের মূল কাঠামোর নকশা করা হয়৷ পানি বাষ্পীভবনে সুপ্ত তাপমাত্রার সূত্র এবং প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় তাপ নিয়ন্ত্রণের ধারণা থেকেই এই প্রকল্পের শুরু৷ অধ্যাপক হোসেন বলেন, দুটো দেয়াল আছে, বাইরের দিকে একটা ও ভেতরের দিকে একটা৷ মধ্যে প্রায় আড়াই ইঞ্চি ফাঁক আছে৷ এই ফাঁক ধানের তুষের কয়লা দিয়ে ভরাট করা হয়, যেখানে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হয়৷ পানি দিলে বাইরের দেয়ালটা ভিজে যায় এবং বাষ্পিভবন ত্বরান্বিত হয়৷ পরে ধীরে ধীরে ভেতরের বাষ্প ও হিট দেয়াল টেনে নেবে এবং একসময় ঘরটা ঠান্ডা হয়ে যাবে৷
প্রাথমিকভাবে তিনশ' টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই শস্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হয়েছে৷ বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের কারণে এই অবকাঠামো অন্তত ২০ বছর পর্যন্ত টেকসই থাকবে৷ অধ্যাপক ড. এম. মনজুর হোসেন এ বিষয়ে বলেন, এটা তৈরি করতে সময় লাগবে তিন থেকে চার মাস৷ ২৫ টন, ৭৫ টন ১৫০ টন থেকে ৩০০ টনেরও হতে পারে৷ চার ধরনের ডিজাইন রয়েছে৷ প্রয়োজন অনুসারে যে-কোনোভাবে এটা তৈরি করা যেতে পারে৷ ৩০০ টনেরটা তৈরি করতে খরচ পড়বে ১৪ লাখ টাকা৷
নানা ধরনের পচনশীল শস্য এতে সংরক্ষণ করা গেলেওমূলত আদা, আলু, রসুন ও পেঁয়াজসংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করা হয়েছে৷ ড. এম. মনজুর হোসেন বলেন, ‘‘এই স্টোরেজের চারটা স্তর রয়েছে৷ এর মধ্যে নীচে একটা, আমি দাঁড়িয়ে আছি একটায়, এর উপরে আছে এক স্তর, তার উপরে আরেকটা স্তর রয়েছে৷ ক্যাটাগরিক্যালি আপনি চার ধরনের শস্য রাখতে পারেন৷ এর মধ্যে নীচে রাখলেন আদা, এই দুটোতে আলু আর উপরে আপনি রসুন ও পেঁয়াজ রাখতে পারেন, অথবা পুরো ঘরে আপনি একটা শস্য রাখতে পারেন৷ এখানে আলু ৫ মাস, আদা ও পেঁয়াজ ৯ থেকে ১০ মাস আর রসুন ১২ থেকে ১৪ মাস পর্যন্ত রাখা যায়৷''
ড. এম. মনজুর হোসেন পরবর্তীতে আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরো দুটি শস্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ করেন, যেখানে কৃষকরা তাদের কৃষিপণ্য দীর্ঘদিন সতেজভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে৷ গবেষণা সহকারী হোসাইন মোঃ জাহিদ বলেন, ‘‘এটা প্রথমে আমরা স্থানীয়ভাবে তৈরি করি৷ পরে দেখলাম, এখানে টেম্পারেচার উঠানামা করে, তাই এটাকে আরো উন্নত করার জন্য আমরা পরেরটাতে কমার্শিয়ালি কমপ্রেশার ব্যবহার করেছি৷ পাশাপাশি সেখানে ইথিলিন ব্যবস্থাপনা সেলুলার লেভেলে কাজ করছে বিধায় এর কার্যক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে৷ পলি ইউরেথিন ফোম দিয়ে আমরা ইনসুলেশন প্রসেসটাকে ব্যবহার করে অনেকটা ডিপ ফ্রিজের আদলে আমরা আমাদের নতুনটা তৈরি করেছি, যেখানে টেম্পারেচার ফ্লাকচুয়েট করবে প্লাস মাইনাস ওয়ান৷ সেক্ষেত্রে আমাদের সবজি ও ফল সতেজ থাকছে৷ আমাদের তিন টনের যে ক্যাপাসিটি আছে, সেটাকে আমার সোলার দিয়েও চালাতে পারবো৷''
অধ্যাপক ড. এম. মনজুর হোসেন মনে করেন, ‘‘কৃষকরা যদি তাঁদের পণ্য এখানে রাখতে পারে, তাহলে তারা অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে এবং তৃণমূলের কৃষকদের উন্নয়নের জন্য এটা একটা মাইলফলক৷''
চাহিদার তুলনায় দেশে হিমাগারের সংখ্যা অনেক কম৷ তাই প্রতি মৌসুমেই শস্য সংরক্ষণে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতায় নামতে হয়৷ স্বল্প খরচ ও পরিসরে এরকম প্রাকৃতিক ও আধুনিক হিমাগার দেশের কৃষি উদ্যোক্তা ও কৃষকদের সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে৷