বাংলাদেশে পোশাকশিল্পে শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত
১৯ অক্টোবর ২০১৭তবে এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কারখানাগুলোর অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছি৷ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে৷ বাংলাদেশে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করেই এই সেক্টরের উন্নতি করা হয়েছে৷ এখন তারা যেটা বলছে, সেটা একেবারেই ঠিক নয়৷ আমরা বিষয়টা তাদের বলবো৷''
বাংলাদেশের জিএসপি পুনর্বিবেচনার দাবি করা জোট পাঁচটি হচ্ছে, ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন, ইন্ডাষ্ট্রঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন, দ্য ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন, দ্য ইউরোপিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন ও ইউএনআই গ্লোবাল ইউনিয়ন৷ তারা শ্রম অধিকারলঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণ করতে গত বুধবার ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের পোশাকশিল্প : সাসটেইনেবল কমপ্যাক্টের ব্যর্থতা' নামে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে৷
এই ৫টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্যে একমাত্র ইন্ডাষ্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়নের বাংলাদেশে সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ ইন্ডাষ্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন তাদের পক্ষে কাজ করে৷ সংগঠনটির মহাসচিব তৌহিদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইন্ডাষ্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন আমাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেয়নি৷ ব্যক্তি পর্যায়ে কারো কাছ থেকে কোনো তথ্য নিয়েছে কি-না সেটা জানি না৷ তবে অবশ্যই বাংলাদেশ নিয়ে তাদের কোনো রিপোর্ট প্রকাশের আগে আমাদের কাছ থেকে তথ্য নেয়া উচিত ছিল৷ তাদের প্রতিবেদন যে ঠিক না আমি এটা বলব না, তবে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে৷ সারা বিশ্বে কোথাও এখন আর বাংলাদেশের পণ্য বয়কট করা হয় না৷ শ্রমিকদের স্বার্থের জায়গায় কিছু দুর্বলতা থাকলেও অবকাঠামো বা তাদের নিরাপত্তায় জায়গায় বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে৷ এখনো এসব কাজ চলছে৷''
জোটের প্রকাশ করা শ্বেতপত্রে শ্রম আইন সংশোধন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)-এ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, ইউনিয়ন নিবন্ধনের উন্নতি এবং ইউনিয়নবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ না হওয়াকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে৷ শ্বেতপত্রে কয়েকটি কারখানার শ্রমিক নির্যাতনের তথ্যও তুলে ধরা হয়৷ শ্বেতপত্রটি ইউরোপিয়ান কমিশনে পাঠানো হয়েছে৷ বিবৃতি দিয়ে তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকার সাসটেইনটেবল কমপ্যাক্ট অমান্য করছে৷ ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শ্রম আইন সংশোধনে সামান্যতম অগ্রগতি হয়নি৷ ইপিজেডে শ্রম সংঘ নিশ্চিত করার বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেটি পরিষ্কার না৷ ইউনিয়ন করতে গিয়ে অনেক কারখানার শ্রমিকেরা নির্যাতিত হওয়ার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে৷ কিন্তু শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ চার বছর সময় পেয়েছে৷
আসলে বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের চিত্রটা কেমন? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক নেত্রী জলি তালুকদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওরা অনেক কিছুই নিয়ে রাজনীতি করে৷ কিন্তু শ্রমিকদের বিষয়ে ওরা যে রিপোর্ট দেয় সেটা ঠিক আছে৷ আমিও মনে করি, বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার এখনো নিশ্চিত হয়নি৷ ২০১৩ সালে সর্বশেষ বেতন কাঠামো হয়েছে৷ চার বছর পার হলেও নতুন কোনো বেতন কাঠামো এখনো হয়নি৷ অথচ এই সময়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দামসহ বাড়ি ভাড়া সবই বেড়েছে৷ আমাদের কারখানাগুলোতে এখনো শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারে না৷ অনেক জায়গায় বাধা দেয়ার অভিযোগ আছে৷ আজও আমরা আশুলিয়াতে সমাবেশ করতে পারিনি পুলিশী বাধার কারণে৷''
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নতি ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে চারপক্ষীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ ওই বছরের জুলাই মাসে জেনেভায় বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও আইএলও'র উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা এক বৈঠকে যোগ দিয়ে ‘স্টেইং এনগেইজড অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট উইথ বাংলাদেশ' নামের উদ্যোগের ঘোষণা দেয়৷ সংক্ষেপে এটি ‘কমপ্যাক্ট' নামে পরিচিত৷ পরে ক্যানাডা যুক্ত হয়৷
গত মে মাসে ঢাকায় কমপ্যাক্টের তৃতীয় পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষায় যৌথ দর-কষাকষির অভিন্ন অধিকার চালু করতে দেশের ইপিজেড আইন সংশোধনের জন্য বাড়তি সময় পায় বাংলাদেশ৷ দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চেয়েছিল ইইউসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারেরা৷
এদিকে, গত বছরের জুনে আন্তর্জাতিক লেবার কনফারেন্স (আইএলসি)-তে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিশেষ অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়৷ এতে বলা হয়, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপের ঘাটতি ও ব্যর্থতা অত্যন্ত উদ্বেগের৷ এ ক্ষেত্রে শ্রম আইন, ২০১৩-তে সংশোধনী আনা, ইপিজেড আইনে সংগঠিত হওয়ার অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করা, ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্যের তদন্ত করা এবং ইউনিয়নের নিবন্ধন স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে করার মতো চারটি প্রসঙ্গ ওই অনুচ্ছেদে এসেছে৷ এসব কারণেই বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়টি যাচাই করতে চাইছে ইইউ৷ অবশ্য গত জুনে জেনেভায় আইএলসিতে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্যমূলক আচরণ ও সহিংসতা বন্ধের জন্য আগামী নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়৷