বাংলাদেশের নদী, নদীর বাংলাদেশ
১৩ জুন ২০১৭নদী ভূমি গঠনের এই পলি বহন করে এনেছে, এখনো আনছে৷ এই ভূমি গঠনের হাজার হাজার বছর পর এখনো সেই নদী মানুষের জীবনে নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রধানতম ভূমিকা রেখে চলেছে৷
আদিকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি৷ সেখানেও মূল ভূমিকায় নদী৷ সাম্প্রতিক সময়ে এই কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি যোগ হয়েছে৷ ব্যবস্থা হয়েছে আধুনিক সেচের৷ এজন্য বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে৷ এর সবগুলোই নদীকে কেন্দ্র করে৷
এক সময় বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার ছিল দক্ষিণাঞ্চল৷ বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চল৷ এক সময় বরিশালকে বলা হতো, ‘ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল'৷ প্রবাদটি প্রচলিত ছিল সারা দেশজুড়েই৷
এই প্রবাদ নদী এবং খালের সঙ্গে ধান উৎপাদনের সম্পর্ককেও বুঝিয়ে দিচ্ছে স্পষ্টভাবে৷
স্বাধীনতার পর খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ বর্তমানে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পর্ণ বলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই দাবি করা হয়৷ যদিও সীমিত পর্যায়ে বাংলাদেশ এখনো চাল আমদানি করে৷
তবুও পরিসংখ্যান বলছে, স্বাধীনতার পর এ দেশের খাদ্য উৎপাদন তিনগুন হয়েছে৷ তাই জনসংখ্যা দ্বিগুন হলেও খাদ্য ঘাটতি কমেছে৷ এই সময়ে উত্তরাঞ্চলে কৃষির ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে৷ দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প, তিস্তা সেচ প্রকল্প এই অঞ্চলেই অবস্থিত৷
উত্তরাঞ্চলজুড়ে থাকা এই প্রকল্পে এখন মাঝেমাঝেই পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না৷ তবে এরপরও এই প্রকল্প পুরো অঞ্চলের ফসলের মানচিত্র বদলে দিয়েছে৷ নতুন সেই মানচিত্র ধরেই চলছে এই অঞ্চলের চাষাবাদ৷
বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরোর ২০১৫ সালের একটি হিসাব বলছে, দেশের মোট ধানের ১০ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন হয় কেবল ময়মনসিংহে৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রংপুর৷ কেবল রংপুরই নয়৷ উত্তরবঙ্গের সবুজ বিপ্লবের পেছনে রয়েছে তিস্তা প্রকল্প৷
সাম্প্রতিক সময়েও মঙ্গার জেলা বলে পরিচিত রংপুর আলু উৎপাদনেও শীর্ষ জেলা৷
উত্তরের নদীগুলো যখন যৌবন হারিয়ে পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে, তখনও যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এখানকার কৃষি৷
নদীর এই পানি যত স্বল্পই হোক, তার সঙ্গে আসে পলি৷ এর ফলে নতুন উর্বরা শক্তিতে, বছর বছর নতুন যৌবন ফিরে পায় বাংলাদেশের কৃষিভূমি৷
যে পলি অব্যবহৃত থেকে যায়, তা গিয়ে জমে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়৷ সেখানে মহাকালের ধারাবাহিকতায় জেগে উঠছে নতুন নতুন ভূমি৷ সদ্বীপ-হাতিয়া থেকে সুন্দরবন– পুরো এলাকাতেই জাগছে বড় বড় এলাকা৷
নদীর অপর দান মাছ৷ বাংলাদেশে সবচেয়ে সুলভ মাছ ইলিশ৷ বাঙালির ইলিশ নিয়ে, ইলিশের রসনা বিলাস নিয়ে কত গল্প কবিতা হয়েছে, তা কি গুনে শেষ করা যাবে?
সেই ইলিশও এই নদীরই দান৷ বিভিন্ন নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার পরও পরিকল্পিত উপায়ে প্রজনন মৌসুমে মা মাছকে রক্ষা করে বাংলাদেশ এখনো ‘ইলিশের দেশ-'এর খেতাব ধরে রেখেছে৷ আরও কত মাছ এখানে পাওয়া যায় তার হিসাব করা বড়ই কঠিন৷
কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজিতে তৃতীয়, মাছে চতুর্থ, ছাগলে চতুর্থ, আলুতে ১০ম স্থানে রয়েছে৷ এসব সফলতার পেছনেও রয়েছে নদী৷
নদী এই দেশে জালের মতো ছড়ানো, এই নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষের জীবন গড়ে উঠেছে৷ নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা, প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওসহ সকল শহর-নগর৷ যাতায়াত মানেই ছিল নদীপথে যাতায়াত৷ সওদাগরী নৌকা পাল তুলে ছুটে যেতো দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে৷
বিভিন্ন নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় গত কয়েক দশকে নদীপথে যাতায়াত কমলেও এরই মধ্যে এর গুরুত্ব বুঝেছে সরকারও৷ এ কারণে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ৷
এই নাব্যতা সংকটের জন্য উজানে প্রতিবেশি ভারতের বিভিন্ন প্রকল্পকেও অনেকে দায়ী করে থাকেন৷ নদীপথে পূর্বাঞ্চলীয় ৭ রাজ্যের ট্রানজিট সুবিধা পেতে নৌপথ ফেরানোর উদ্যোগে শামিল হয়েছে তারাও৷ এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এ বিষয়ে সমঝোতা চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে৷
এটা সফল হলে পূর্বের সওদাগরী নৌযানের পাশাপাশি যাত্রী পরিবহণকারী নৌযানও চলবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসাম পর্যন্ত৷
নদীতে নৌকা চালিয়েও বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে৷
২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ৷ বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে নদীভিত্তিক পর্যটনও পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব৷
পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে তৈরি করা বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র এবং স্বল্প দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্যচিত্রেও এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে৷
বাংলাদেশে এখনো শিল্প কারখানা স্থাপনেও গুরুত্ব দেওয়া হয় নদীপথের যোগাযোগকে৷ মালামাল পরিবহণে নদীকে ব্যবহার করা গেলে খরচ কম পড়ে৷ বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে পাওয়া যায় অধিক শক্তি৷
যে নদীর পলিতে বাংলাদেশের জন্ম, সেই নদীকেই ঘিরেই এখনো বেঁচে আছে বাংলাদেশ৷ বাঁচতে হবে আরো বহুদূর৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷