বাম ভোট বিজেপিতে?
১৩ মে ২০১৯ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে সাতটি দফায় ভেঙে, এক মাস ধরে ভোটপর্ব চালানোর উদ্দেশ্য একটাই– যাতে নরেন্দ্র মোদী পূর্ব ভারতে বারবার এসে প্রচার করতে পারেন৷ এ কথা প্রথমেই বলেছিলেন বিরোধীরা৷ পূর্ব ভারতকে এত গুরুত্ব দেওয়ার একটাই কারণ৷ উত্তরপ্রদেশে গত বিধানসভা ভোটেই মোদী টের পেয়েছেন, সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টির জোট হলে, তার ফল বিজেপির পক্ষে বিষময় হতে পারে৷ এবারেও সেই অলিখিত জোট হয়েছে উত্তরপ্রদেশে এবং সেই জোটে শামিল না হলেও পুরোদস্তুর লড়াইয়ে আছে কংগ্রেস৷ কাজেই ভারতের সবথেকে বেশি লোকসভা আসন যে রাজ্যটিতে, যেখানে ভালো ফল করলে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসা সুনিশ্চিত হয় বলে বলা হয়ে থাকে, সেখানে বিজেপি এবার বেশ বেকায়দায়৷ লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে যে বিজেপি বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না, সেকথা শুধু বিরোধীরা বলছে না, বিজেপি নেতৃত্বও বিলক্ষণ জানে৷
ফলে নজর পড়েছে পূর্ব ভারতে ,বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে৷ কেন, পশ্চিমবঙ্গে কেন? কারণ, নরেন্দ্র মোদী দলীয় সূত্রে এবং সম্ভবত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রেও জানতে পেরেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যের সাধারণ মানুষের একাংশ নানা কারণে ক্ষুব্ধ৷ তাঁরা মমতাকে শায়েস্তা করতেই এবার বিজেপিকে ভোট দিতে পারেন৷ এদের পাশাপাশি আছেন বামপন্থি কর্মী–সমর্থকরা, যাঁরা মমতার হাতে পর্যুদস্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ক্ষোভ, শোক এবং রাগ এখনো হজম করতে পারেননি৷ আজ যখন বিজেপি ছলে-বলে-কৌশলে পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক জমি তৈরি করতে পেরেছে, মমতাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বাম ভোটাররা৷ ফলে তাঁদের ভোট এবার বিজেপি পেতে পারে৷ এর পাশাপাশি আছেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি শ্রেণি, যাঁরা জননেত্রী মমতার প্রশাসনিক কর্তৃত্বে উত্থান থেকে শুরু করে তাঁর ইংরেজি বলতে না পারা, তাঁর ভুল উচ্চারণ, সব কিছুতেই বিরক্ত৷ আর এর পাশাপাশি আছেন সেই গোত্রের লোকেরা, যাঁরা হিন্দুত্ববাদী না হন, অবশ্যই মুসলিম-বিরোধী এবং মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়কে অকারণ, অনাবশ্যক তোষণ করে চলেছেন৷ বাম জমানায় তাঁরা নিজেদের মুসলিম-বিরোধিতা সেভাবে প্রকাশ করতে পারেননি, এখনো পারছেন না, কিন্তু তাঁদের জমে থাকা ক্ষোভ বেরিয়ে আসার একটা রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে বিভাজনের রাজনীতিতে পটু বিজেপি৷ এই তিন গোত্রের লোকেরা এবার বিজেপিকে ভোট দেবেন, একসময় যে ভোটটা বামফ্রন্টের দিকে যেতো৷
একা নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর দলই যে পশ্চিমবঙ্গে ভোটারদের এই মেরুকরণের খবর রাখছেন, তা নয়৷ তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও পরোক্ষে এই বাস্তবতা স্বীকার করছেন৷ এ কারণে সমস্ত জনসভায় তিনি বলছেন, বিজেপি-বিরোধী ভোট যেন ভাগ না হয়৷ যেহেতু রাজ্যে লড়াইটা মূলত তৃণমূল বনাম বিজেপি, মমতা এমন কথাও বলছেন যে, ‘‘বাম দলগুলো, বা কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে ভোটটা নষ্ট করবেন না৷ ভোটটা এবার তৃণমূলকে দিন৷'' অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এবং প্রভাবে একেবারে পিছনের সারিতে চলে যাওয়া বাম নেতারাও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝছেন যে, এবার অনেক বাম ভোট বিজেপির দিকে পড়বে৷ এ কথাটা প্রকাশ্যে বলে ফেঁসে গেছেন সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাট৷ তাঁর মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন সূর্যকান্ত মিশ্র, সুজন চক্রবর্তীর মতো বাম নেতারা৷ তাঁরা মনে করেন, কারাটের এই কথায় ভুল বার্তা পৌঁছবে ভোটারদের কাছে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে মুখ খুলতে হয়েছে রাজনৈতিক সন্ন্যাসে চলে যাওয়া রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে৷ তিনি সম্প্রতি বাম ভোটারদের কাছে আবেদন রেখেছেন যে, বিজেপিকে ভোট দেওয়ার মতো বড় ভুল যেন কোনো বামপন্থি না করেন৷ সেটা গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোয় ঝাঁপ দেওয়ার মতো ব্যাপার হবে৷ বুদ্ধদেব এমন কথাও বলেছেন যে, রাজ্যে এখন তৃণমূলের থেকেও বড় শত্রু হলো বিজেপি, কাজেই বিজেপিকে একটি ভোটও নয়৷
কিন্তু ঘটনা হলো, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই মন্তব্যও পরোক্ষে স্বীকার করছে যে, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা নিশ্চিতভাবেই আছে যে, তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা ব্যানার্জিকে বেকায়দায় ফেলতে নিজেদের ভোটটা বিজেপিকেই দেবেন৷ এবং তাতেই উৎসাহিত রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব৷ মমতার দাবিমতো ‘বেয়াল্লিশে বেয়াল্লিশ' এবং ‘বিজেপি গোল্লা' না হোক, পশ্চিমবঙ্গে যেখানে বিজেপির একটি-দুটি আসন পাওয়াই হতো অতীতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেখানে রাজনৈতিক মহলের কানাঘুষো, ৪২ টির মধ্যে অন্তত ১০টি আসনে এবার গেরুয়া পতাকা উড়বে৷ অতি উৎসাহীরা প্রায় অর্ধেক আসনই দিয়ে রাখছেন বিজেপিকে৷ কারণ, এ রাজ্যের প্রায় ৪০% বাম ভোট এবার কোন দিকে পড়বে, সেটা একটা নির্ধারক বিষয় হয়েই থাকছে৷