বামফ্রন্ট ও তারুণ্য : বাস্তব ও নির্বাচন
২১ মার্চ ২০২১হাতে গুনে সাত দিন৷ এরপরই শুরু হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন৷ নির্বাচনি উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে কোন দলে কারা প্রার্থী, সেই আলোচনা৷ অন্যান্যবারের চেয়ে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগে-পরের পরিস্থিতিতে একেবারে দিন-রাতের পার্থক্য৷ আলোচনার অনেকটা জুড়েই রয়েছে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী তালিকা৷ ২০১১ সালে বাম সরকার পতনের পর থেকেই তাদের প্রতি অভিযোগ উঠছিল, নতুনদের স্থান নেই প্রবীণ নেতৃত্বে অতি নির্ভরশীল বামফ্রন্টের৷ দশ বছর পর, সেই বামফ্রন্টের নির্বাচনি স্ট্র্যাটেজি, প্রচারের ফর্ম-কন্টেন্ট থেকে দলীয় মুখ, সর্বত্রই তারুণ্যের অনস্বীকার্য ছাপ৷ তবে কি বদলাচ্ছে বামেদের অন্দরমহল? নাকি এই নতুনের উদযাপন শুধুই চমক জাগানোর কৌশল?
তরুণ ভোটার ও সাংবাদিক রোশনি চক্রবর্তীর মতে, ‘‘সিঙ্গুরের মতো হাই ভোল্টেজ কেন্দ্র থেকে সৃজন ভট্টাচার্য দাঁড়িয়েছেন৷ এটা অবশ্যই সাহসী পদক্ষেপ৷এটা আরো আগে নেওয়া উচিত ছিল৷” প্রার্থী তালিকায় নতুন মুখ এত বেশি দেখা না গেলেও বাম মহলে এই মনোভাব নতুন নয়, জানাচ্ছেন এবারের নির্বাচনের প্রার্থী মধুজা সেনরায়৷ সংযুক্ত মোর্চার হয়ে ঝাড়গ্রাম থেকে লড়াই করছেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) অর্থাৎ সিপিআইএমের মধুজা, যিনি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় ছাত্র রাজনীতিতে গত কয়েক বছর ধরে নজর কেড়ে আসছেন৷ তার মতে, ‘‘তরুণদের সামনে আনার কথা দলের প্লেনাম থেকেই বলা হয়েছে, এটা একদিনে হয়েছে এমনটা নয়৷ নতুনদের জায়গা করে দেবার জন্য পশ্চিমবঙ্গের এরিয়া কমিটিতে ত্রিশের কম বয়সিদের নেবার জন্য শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়েছে৷ সেখান থেকেই এই তরুণ মুখরা উঠে এসেছেন৷” আরেক তরুণ সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ির মতে, সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী তালিকা বামেদের বিরুদ্ধে ওঠা প্রবীণনির্ভরতার অভিযোগে সরাসরি আঘাত করতে পারলেও নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা প্রমাণপেক্ষ৷ তার বক্তব্য, ‘‘সামাজিক মাধ্যমে এই সব কমবয়সি বামপন্থি প্রার্থী যতখানি নন্দিত হচ্ছেন, এলাকায় ঠিক ততটা নয়৷ তাদের অধিকাংশকেই লড়তে হচ্ছে ভাঙাচোরা, বেহাল সংগঠনের ভরসায়৷”
বিধানসভায় নবীন-প্রবীণ
তবে কি বামেদের তরুণ তুর্কিদের মধ্যে জয়ের কোনো আশাই দেখছেন না কেউ? এ প্রশ্নে অর্ক ভাদুড়ি বলেন, ‘‘বামেদের তরুণ মুখের মধ্যে যার জেতার সম্ভাবনা সবচেয়ে উজ্জ্বল, তিনি চাকুলিয়ার ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী ভিক্টর৷ আগেও জিতেছেন তিনি৷ জামুরিয়া কেন্দ্রে জেএনইউএসইউ-এর নেত্রী ঐশী ঘোষও ভালো লড়াই দেবেন৷ জিতেও যেতে পারেন৷ এর বাইরে বামেদের তরুণ মুখেদের বিধানসভায় যাওয়া মুশকিল৷ সবচেয়ে আলোচিত বাম প্রার্থী মীনাক্ষী মুখার্জি৷ হেভিওয়েট কেন্দ্রে আপ্রাণ লড়ছেন৷ কিন্তু ১০ শতাংশ ভোট পেলেই যথেষ্ট বলে মনে হয়৷ নন্দীগ্রামে গিয়ে মনে হয়েছে আড়াআড়ি বিভাজিত নন্দীগ্রামে মীনাক্ষীর সম্ভাবনা নেই৷ সিঙ্গুরে সৃজন ভট্টাচার্য বরং কিছুটা লড়বেন৷ বিজেপির অর্ন্তবিরোধ হয়তো তাকে অক্সিজেন দেবে৷ আরেকজন তরুণ প্রার্থীর কিন্তু সংযুক্ত মোর্চার টিকিটে জিতে বিধানসভায় যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল৷ ভাঙড় কেন্দ্রের আইএসএফ প্রার্থী পীরজাদা নওশাদ সিদ্দিকি৷ এর বাইরে সংযুক্ত মোর্চার বাম প্রার্থীদের মধ্যে যাদের জেতার সম্ভাবনা ভালো, তাদের অধিকাংশই প্রবীণ৷ শিলিগুড়িতে অশোক ভট্টাচার্য, শালবনীতে সুশান্ত ঘোষ, যাদবপুরে সুজন চক্রবর্তী, চণ্ডীতলায় মহম্মদ সেলিম, রায়দিঘিতে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রার্থীরা জেতার জায়গায় আছেন৷”
জয়ের হিসাবে তরুণদের চেয়ে প্রবীণরা এগিয়ে থাকলেও ভোটদানের ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর তরুণ ভোটার, বিশেষ করে তারা, যারা এবারেই প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন৷ সেইসব ভোটারদের কাছে সংযুক্ত মোর্চা তথা বামেরাই ‘লেসার ইভিল’ বা মন্দের ভালো ঠেকছেন বলে মত সাংবাদিক ও তরুণ সমাজকর্মী প্রিয়ম সেনগুপ্তের৷ শুধু তাই নয়, তারুণ্যের পক্ষের সিদ্ধান্ত আসলে নির্বাচনি ‘মাস্টারস্ট্রোক’ তা-ও মনে করছেন প্রিয়ম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘তরুণ প্রার্থী দেওয়ার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই উঠছে৷ সেটা নতুন কিছু নয়৷ তবে তারুণ্যের দাবি মেনে নেওয়াটা মাস্টারস্ট্রোক৷ ‘পলিটব্যুরো মানে পলিত কেশের বুড়ো’ ধরনের বিদ্রুপ বাম কর্মীদের মধ্যেও শুনেছি৷ আর সেটা আজ থেকে নয়, অনেকদিন ধরেই শুনেছি৷ এবার যে সেটা মেনে নেওয়া হলো, সেটাই বড় কথা৷ পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াকে ঠিক করে ইউজ করা, টুম্পার মতো গান ব্যবহার করা, ফ্ল্যাশমব করা— এগুলোই প্রমাণ করে দিচ্ছে, বাম নেতৃত্ব তারুণ্যের দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে৷ হয়তো এটাও অলিখিতভাবে পার্টির অন্দরে অনুভূত হয়েছে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রদের মতো প্রবীণদের ফর্মুলা আর কাজ করবে না৷ হয়তো এটা পার্টির পক্ষে ভালো হবে৷’’
দলে থেকে কাজ?
এছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গের শিরোনামে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত শব্দবন্ধ – দল বদল৷ যদিও কলকাতা শহরজুড়ে দেখা যাচ্ছে সংযুক্ত মোর্চার ব্যানারে লেখা ‘দল বদল নয়, দিন বদল’, তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়৷ ভোটপরবর্তী প্রেক্ষিতে সরকার না গড়তে পারলে কি অন্য দলের সাথে জুড়তে দেখা যাবে এই তরুণ প্রার্থীদের? কতটা নিশ্চয়তা দেবেন তারা ভোটারদের? এ প্রশ্নের জবাবে মধুজা সেনরায় বলেন, ‘‘যদি ভবিষ্যতে এরকম হয়, তাহলে সেটা খুবই বিচ্ছিন্নভাবে হবে৷ আমাদের রাজনীতি শুধু ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতি তো নয়৷ আমাদের সংযুক্ত মোর্চা তৈরি হয়েছে লড়াইয়ের মাঠ থেকেই৷ গত পাঁচ বছরে আমরা বিভিন্ন আন্দোলনে একসাথে কাজ করে এসেছি৷ ফলে, যে রাজনীতি আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, সেখানে এ ধরনের সিট বা ভোটভিত্তিক কাজের জায়গা নেই৷’’
এবারের নির্বাচন থেকে কীভাবে বদলাবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার চেহারা, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরো মাস দেড়েক৷ কিন্তু ২০২১ সালের বামফ্রন্ট যে ‘বৃদ্ধতন্ত্রের’ অভিযোগ থেকে গা ঝাড়া দিতে তৎপর, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট৷ এই মুহূর্তে সংযুক্ত মোর্চার সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ নিজস্ব প্রার্থীদের নির্বাচনের পরেও লড়াইয়ের ময়দানে ধরে রাখা, যা পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির বাঁক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন৷