বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে রণক্ষেত্র ঢাকা, প্রতিবাদে রোববার হরতাল
২৮ অক্টোবর ২০২৩দীর্ঘদিন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চলার পর হঠাৎ করেই উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজধানী ঢাকার রাজপথে৷ শনিবার মহাসমাবেশ শুরুর আগেই পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন বিএনপির কর্মীরা৷
এর জের ধরে বিএনপির মহাসমাবেশ অনেকটাই পণ্ড হয়ে যায়৷ বিএনপি কর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাড়ি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল, পুলিশ বক্সে হামলা চালায়৷ বেশ কয়েকটি বাস ও অ্যাম্বুলেন্সে আগুন ধরিয়ে দেয়৷
পুলিশও বিএনপি নেতা-কর্মীর উপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে৷ সংঘর্ষের মধ্যে বেধড়ক পিটুনির শিকার হয়ে একজন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন৷ আহত হয়েছেন বিএনপির বিপুলসংখ্যক কর্মী৷ প্রতিবাদে রোববার সারাদেশে হরতাল ডেকেছে দলটি৷
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কাকরাইল মসজিদের সামনে ঘটনার সূত্রপাত৷ ওই পথ ধরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের একটি বাস যাওয়ার সময় বাসের জানালায় ইট এসে পড়ে৷ তখন আওয়ামী লীগের কর্মীরা দ্রুত বাস থেকে নেমে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান৷ এর মধ্যে বিএনপির একটি মিছিল থেকে বাসে ভাঙচুর করা হয়৷ এ সময় পুলিশ এগিয়ে গেলে সংঘর্ষের শুরু হয়৷
পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে৷ এরপর সংঘাত একটু করে বাড়তে থাকে৷ তখন বিএনপি নেতা-কর্মীরা পাশেই প্রধান বিচারপতির বাড়ির ফটকে হামলা চালায়৷ তারা বাড়ির নামফলক ভেঙে ফেলেন৷ গেটেও ভাঙচুর করেন৷
বেলা একটার কিছু আগে সংঘর্ষের ছড়িয়ে পড়ে কাকরাইল মোড়ের দিকেও৷ পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের জবাবে বিএনপি কর্মীরাও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন৷ বেশ কয়েকজন বিএনপি কর্মীকে পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল তুলে উল্টো পুলিশের দিকে ছুড়ে মারতে দেখা যায়৷ কাকরাইল মোড়ে একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বেলা সোয়া একটার দিকে আগুন দেওয়া হয়৷
ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) ভবনে রাখা গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে কাকরাইল মসজিদের সামনে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন করা হয়৷
সংঘর্ষের এক পর্যায়ে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আগুন দেওয়া হয়৷ পুলিশ বলছে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা হাসপাতালে আগুন দিয়েছে৷
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালে আগুন দিয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা৷ সেখানে তারা দুটি অ্যাম্বুলেন্সে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশি বাধার মুখে বিএনপির নয়াপল্টনের সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়৷ সমাবেশ শেষ হওয়ার আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোববার হরতালের ঘোষণা দেন৷ ধাওয়া খেয়ে নেতা-কর্মীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন৷
পরে নয়াপল্টন এবং রাজধানীর অন্যান্য স্থানে বিএনপি-পুলিশের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে৷ এসব ঘটনায় বিএনপির বহু নেতা-কর্মীর পাশাপাশি পুলিশ ও সাংবাদিকেরা আহত হয়েছেন৷
পুলিশ দাবি করেছে, তাদের ৪১ জন সদস্য আহত হয়েছেন৷
আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ সাংবাদিক
সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্তত ১৫ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন৷ দৈনিক বাংলা মোড়ে ফেসবুকে লাইভ করতে বিএনপির কর্মীদের হামলার শিকার হন ইত্তেফাক মাল্টিমিডিয়ার রিপোর্টার তানভীর আহমেদ৷ দুপুর ১ টার দিকে কাকরাইল তাবলীগ মসজিদ মোড়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে লাইভ করতে গিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের হামলার শিকার হন ইত্তেফাকের আরেক মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার শেখ নাছের৷
এছাড়া সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছেন ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদক সিরাজুম সালেকীন৷ তার একটি পা ভেঙ্গে গেছে৷ তাকে চিকিৎসার জন্য জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়েছে৷
এছাড়াও নিউ এজ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি আহমেদ ফয়েজ, দৈনিক কালবেলার প্রতিবেদক রাফসান জানি, গ্রিন টিভির বিশেষ প্রতিনিধি রুদ্র সাইফুল্লাহ ও ক্যামেরাম্যান আরজু, ব্রেকিং নিউজের কাজী ইহসান বিন দিদার, আহসান হাবিব সবুজ, ইনকিলাবের ফটোসাংবাদিক এফ এ মাসুম, বাংলা ট্রিবিউনের সালমান তারেক শাকিল, দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদক আরিফুর রহমান রাব্বি, বাংলানিউজের জাফর আহমেদ, ফ্রিল্যান্সার মারুফ আহত হয়েছেন৷
মারা গেছেন এক পুলিশ সদস্য
ফকিরাপুল মোড়ে হামলার শিকার হয়ে পারভেজ নামে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়েছেন৷ তার বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে৷ বিকেল সোয়া ৪টার দিকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়৷ এরপর, কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷
ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, মৃত অবস্থাতেই ওই পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল৷ তার মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে৷
ওই পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে আসা রায়হান রাবদি নামে এক যুবক জানান, ফকিরাপুল মোড়ে পুলিশের ওপর যখন হামলা হয় তখন ওই পুলিশ সদস্যসহ চার পুলিশ একটি ভবনে ঢুকে পড়েন৷ ভয়ে তাদের সঙ্গে ভবনটিতে ঢুকেন রায়হান৷ সেখান থেকে হঠাৎ ওই পুলিশ সদস্য বাইরে বেরিয়ে যান৷ তখনই তার উপর হামলা চালানো হয়৷
বিক্ষোভকারীরা পুলিশ সদস্যের মাথায় আঘাত করেন৷ সেখান থেকে অন্য পুলিশের সহায়তায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন তিনি৷
মারা গেছেন আরো একজন
নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের সময় আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে৷ নিহত শামীম মোল্লা রাজধানীর মুগদা এলাকার বাসিন্দা৷ তিনি বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদলের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি বলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে৷
যুবদলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দুপুরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে আহত হয়ে শামীম মোল্লা মারা গেছেন৷ বিকেলে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়৷
তবে তার বাবা মুদি দোকানি ইউসুফ মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ছেলে কোনো দল করে না৷ আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে৷ এর মধ্যে শামীম সবার বড়৷ সে একজন চিকিৎসকের গাড়ি চালায়৷ কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না৷ ওই এলাকায় কেন গিয়েছিল আমি জানি না৷’’
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক মো. রেজাউল হায়দার বলেন, ‘‘তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই৷ ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন৷’’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুন অর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বিনা উসকানিতে হামলা করেছে পুলিশ৷ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পুলিশ হামলা চালিয়ে আমাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে৷ পুরো সমাবেশস্থলে তারা তাণ্ডব চালিয়েছে৷''
দলের সিনিয়র নেতাদেরও বেধড়ক পেটানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজেও চার-পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছেছি৷ আমি সব জায়গায় পুলিশকে এমন মারমুখি অবস্থায় দেখেছি৷’’
বিকেলে রাজধানীর তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে৷ বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে কাকরাইল, মালিবাগ ও কমলাপুরে আগুন দেওয়া হয়৷ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা৷ একই সময়ে কমলাপুরে বিআরটিসির একটি বাসেও আগুন দেওয়া হয়৷
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, ‘‘বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি নিলেও প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালিয়েছে৷ পুলিশের সঙ্গে তারা সংঘর্ষে জড়িয়েছে৷ পাশাপাশি পুলিশ হাসপাতাল এবং রাষ্ট্রীয় অনেক ভবনে হামলা চালিয়েছে তারা৷’’
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘পুলিশ জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য পাল্টা অ্যাকশনে গেছে৷ বিএনপি সন্ত্রাসী কায়দায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে৷ ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷’’
বিএনপির ডাকা হরতাল প্রসঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন বলেন, ‘‘আমি এখনও বিএনপির হরতাল কর্মসূচির বিষয়ে জানি না৷ যদি তারা এ ধরনের কর্মসূচি দিয়ে থাকে এবং হরতালের নামে যদি কেউ নৈরাজ্য করে তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে৷’’
ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ-কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, ‘‘শুধু ফকিরাপুল, রাজারবাগ হাসপাতাল নয়, কাকরাইলে আইডিবি ভবনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুর চালিয়েছে৷ তাদের ইট-পাটকেলের আঘাতে মন্ত্রী পাড়ার বিভিন্ন ভবনের জানালার কাঁচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
‘‘পুলিশের ওপর আঘাত করেছে৷ গাড়িতে আগুন দিয়েছে৷ সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা করেছে৷ বেশ কয়েকটি পুলিশ বক্সে আগুন দিয়েছে৷''
এদিকে, একই সময় আরামবাগ মোড়ে সমাবেশ করেছে জামায়াত৷ বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ৷ এই দুই সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে৷ তবে আওয়ামী লীগের সমাবেশে আসা সবার হাতে ছিল লাঠি৷ অনেকটা মারমুখী অবস্থানে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা৷
সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘হরতাল এখন ভোঁতা অস্ত্র৷ এ অস্ত্রে কোনো কাজ হবে না৷ আমরা শান্তি চাই৷ এজন্য সারা দেশে আগামীকাল শান্তি সমাবেশ করব৷''
বিএনপিকে ‘খুনি ও সন্ত্রাসীদের দল' আখ্যায়িত করে কাদের বলেন, ‘‘তারা আজকে তাদের পুরোনো চেহারায় ফিরে এসেছে৷ এদের বিরুদ্ধে খেলা হবে৷''
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আজকে কী ঘটেছে তা সবাই দেখেছেন৷ বিএনপি যে একটা সন্ত্রাসী দল সেটা আমরা আগেই বলেছিলাম৷ আজ তারা প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা চালাল৷ এমনকি রাজারবাগ হাসপাতালেও তারা আগুন দিয়েছে৷ আজ তাদের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে৷ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ প্রতিহত করা হবে৷''
বিএনপির ডাকা হরতালের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি৷ শনিবার সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘‘বিএনপির ডাকা আগামীকালের হরতালে ঢাকা শহর, শহরতলি ও আন্তঃজেলা রুটে বাস-মিনিবাস চলাচল অব্যাহত থাকবে৷''
অন্যদিকে, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়ের করা নাশকতার অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি-জামায়াতের ৮৪১ নেতা-কর্মীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে শনিবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একাধিক বিচারকেরা এই আদেশ দেন৷