বিশ্বকাপ ২০২২: নীরব প্রতিবাদ ইরানের
২২ নভেম্বর ২০২২ইংল্যান্ডের কাছে ৬-২ গোলে হারের পর ইরানের কোচ কার্লোস কুইরোজ জানান, তার খেলোয়াড়রা "দেশের ইস্যুতে প্রভাবিত হয়েছেন"।
সোমবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাইতে অস্বীকার করে নীরবে দাঁড়িয়েছিলেন ইরানের ফুটবলাররা। তাদের এই সিদ্ধান্তে ইরানের ভক্তরা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। খেলোয়াড়দের সমর্থনে সমবেত উল্লাসে গানটি উপেক্ষা করার চেষ্টা করেন অনেক সমর্থক। কেউ কেউ চোখে জল নিয়েকরতালিও দেন।
ইরানের কোচ কার্লোস কুইরোজ বলেন, "সবাই পরিস্থিতি জানে। দেশের পরিস্থিতি ফুটবলে মনোযোগ দেয়ার মতো অনুকূল নয়। ফুটবলাররা এই সমস্যায় প্রভাবিত হয়েছেন। ওরা মানুষ, ওরা আসলে শিশুর মতো।"
কার্লোসের কথায়, "আপনারা জানেন না এই বাচ্চাগুলো গত কয়েকদিনে কীভাবে দিন কাটিয়েছে।কারণ, তারা শুধুমাত্র ফুটবল খেলতে চায়।"
খেলার আগে, ইরানের অধিনায়ক এহসান হাজসাফি ইরানের সমস্ত শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, "আমরা তাদের পাশে আছি, আমরা তাদের সমর্থন করি। আমরা তাদের সমবেদনা জানাই।"
ম্যাচের চেয়েও বেশি
ইরানের হাজার হাজার সমর্থক দোহার খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন। ইরান ৬-২ ব্যবধানে ম্যাচটি হেরে গিয়েছে। কিন্তু কিক-অফের অনেক আগেই স্পষ্ট ছিল, এটি আসলে আন্তর্জাতিক ফুটবলের অন্য কোনো ম্যাচের চেয়ে অনেক বেশি কিছু হতে চলেছে।
ইরানের কিছু সমর্থক বেরিয়ে এসে রীতিমতো উল্লাস করেছেন। কেউ কেউ টি-শার্ট পরেছেন, যার গায়ে লেখা ছিল: "নারী, জীবন, স্বাধীনতা"। বিরতির সময়ে, এই তিনটি শব্দ সম্বলিত ইরানের বিশাল একটি পতাকা দেখা গিয়েছে গ্যালারিতে।
অন্য এক ইরানি সমর্থকের টি শার্টে লেখা ছিল, "৭৫ মিলিয়ন। আমরা পরিবর্তন চাই, কিন্তু এমন পরিবর্তন নয় যা ইরানকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।" এক নারী তার পরিবারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ম্যাচের টিকিটের ছবি তুলছিলেন, হাসছিলেন। বিশ্বকাপে নিজের দলের খেলা দেখার সুযোগ পেয়ে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। ম্যাচে উপস্থিত বেশিরভাগ সমর্থকের কাছে এটি আবেগপূর্ণ মুহূর্ত ছিল।
রোজিতা নামের ওই নারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ইরানের শাসক আমাদের হত্যা করছে। আমি এখানে এসেছি, কারণ তারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে। শুধু ইরানের জন্য, আমার দেশের জন্য এসেছি এখানে। ইরানের শাসকদের জন্য নয়। আমরা ইরানি শাসকদের ঘৃণা করি।আমরা আলি করিমি, আলি দাইকে পছন্দ করি। যারা ইরানের জনগণকে সমর্থন করেন- আমরা তাদের পছন্দ করি। যারা ইরানের জনগণকে সমর্থন করেন না, তাদের পছন্দ করি না। "
'আমরা ইরানি'
ফাতেমার জন্য এটা ছিল আনন্দ ও বেদনার মুহূর্ত। তিনি জানান, "আমি বিশ্বকাপে এসে খুব খুশি কিন্তুআমার দেশের মানুষ যে ভালো নেই। আমি প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা পেলাম। ইরানে নারীদের স্টেডিয়ামে যেতে দেওয়া হয় না। এই প্রথম আমার ভাই এবং আমি স্টেডিয়ামে এসেছি।"
এই বছরের আগস্টে, চার দশকেরও বেশি সময় পর ইরানি কর্তৃপক্ষ প্রথমবার নারী ফুটবল সমর্থকদের পুরুষদের লিগের ম্যাচ দেখার অনুমতি দেয়।
খেলার আগে বেহমান বলেন, "আমার মনে হয়, এখানে ইরানের সব মানুষের হৃদয় দেশের মানুষের সঙ্গে জুড়ে আছে।"
কিছু সমর্থক যদিও কথা বলতে চাননি বা তারা চাইছিলেন শুধু ফুটবল নিয়ে কথা হোক।
আবদুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি বলেন, "আমরা ফুটবল অনুরাগীরা এখানে খেলা দেখতে এসেছি। ইরানে যা ঘটছে তা নিয়ে কথা বলার জন্য নয়।"
অশান্তির মাস
সেপ্টেম্বরে ২২ বছর বয়সি মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আমিনির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, "নারী, জীবন, স্বাধীনতা" শব্দগুলি প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল। তখন ইরান জুড়ে মিছিল শুরু হয়। বিক্ষোভ থামাতে শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়, হাজার হাজার নাগরিককে কারাবাসে পাঠানোর অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে।
বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে, ইরানের রেকর্ড গোল স্কোরার এবং বায়ার্ন মিউনিখের সাবেক স্ট্রাইকার আলি দাই ইরানি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শনের জন্য টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। ইরানের খেলা চলাকালীন, দাই এবং করিমির পক্ষে সমর্থনের স্লোগান ওঠে।
সেপ্টেম্বরে তারকা খেলোয়াড় এবং বায়ার লেভারকুজেনের ফরোয়ার্ড সার্দার আজমাউন ইনস্টাগ্রামে লেখেন, "মাহসা আমিনির ঘটনায় আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছে। আমি সবসময় আপনাকে সমর্থন করবো। আমি আশা করি যে একদিন এই দেশে আপনার স্থান ন্যায়সঙ্গত হবে। আমি আশা করি, এ দেশের নারীরা আমার দেশে আর কখনো এরকম কষ্ট পাবে না।"
অনেকে ভেবেছিলেন যে তিনি বিশ্বকাপের স্কোয়াডও তৈরি করতে পারবেন না। বিক্ষোভের সমর্থনে তার ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল ছবি কালো করে দেওয়ার পরে আজমাউন ইনস্টাগ্রামের স্টোরিতে বারবার মেয়েদের সমর্থনে পোস্ট করেন। তিনি বলেন: "এটি ইরানি নারীদের একটি চুলের জন্য বলিদানের মূল্য। লজ্জিত হচ্ছি এই ভেবে যে, এত সহজে এরা মানুষকে হত্যা করে। ইরানি নারীরা দীর্ঘজীবী হোন।"
আজমাউন কাতারে রয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে না খেললেও তিনি বেঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি মাঠে নামতেই সমবেত দর্শকদের বিপুল উচ্ছ্বাস দেখা যায়। তবে মেহেদি তোরাবির ক্ষেত্রে এটি হয়নি।
জাতীয় সংগীতের সময় প্রতিবাদ থেকে শুরু করে গ্যালারিতে দৃশ্যমান আবেগ এবং তারপর কুইরোজের বক্তব্য, সবমিলিয়ে এটি ছিল ইরানের ফুটবলের এক ঐতিহাসিক দিন। দুটি গোল দেখে সমর্থকরা উচ্ছ্বাসে ভেসেছেন। কিন্তু অনেকের কাছে এটা স্পষ্ট, কাতারের এই ফুটবল মাঠের বাইরে ইরানের কাঙ্ক্ষিত জয় হয়েছে।
জোনাথন হার্ডিং/আরকেসি