বিশ্বভারতীতে কালী চর্চায় বিতর্ক, উপাচার্যের সাফাই
২৬ জুলাই ২০২২বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বিষয়ে বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। সেই বক্তৃতামালায় ২৫ জুলাই, অর্থাৎ সোমবারের বিষয় ছিল কালীপুজোর ধারণা। এই নিয়েই প্রবল বিতর্ক শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মূর্তিপুজোয় বিশ্বাস করতেন না। ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। এই পরম্পরা ধরে রাখেন রবীন্দ্রনাথ ও তার পরবর্তী আশ্রম পরিচালকরা। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু দেবী কালীকে নিয়ে আলোচনাকে ঐতিহ্য বিরোধী বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্র-ছাত্রী ও প্রাক্তনীদের একাংশ।
সোমবার বক্তৃতাসভার দিনে ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভের কর্মসূচি নিয়েছিল। ক্যাম্পাসের বাইরে ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে অবস্থান করেন পড়ুয়াদের একাংশ। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সোমনাথ সৌ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজ্য রাজনীতিতে যখন কালী নিয়ে বিতর্ক চলছে, তখন উপাচার্য এ নিয়ে বক্তৃতার আয়োজন করে আরএসএস-বিজেপির গুডবুকে থাকতে চাইছেন। এটা তিনি করছেন ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এই ধরনের আলোচনা বিশ্বভারতীর মূল ভাবনাকে আঘাত করে বলে আমরা প্রতিবাদ করছি।’’
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ শুরুতে অফলাইনে বক্তৃতাসভার আয়োজন করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সভাকক্ষে আলোচনা আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু পরে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত বদলে অনলাইনে সভা করে। সভার অন্যতম আলোচক রামকৃষ্ণ মিশনের শারদাত্মানন্দ মহারাজ বোলপুরে আসেননি। তিনি অনলাইনে বক্তৃতা করেন।সূচনায় বক্তৃতা করেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। কালী-কেন্দ্রিক বিষয় নির্বাচনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘‘যেসব কারণে কালীর ধারণা সমাজে তৈরি হয়েছে, সেটা বিশ্লেষণের চেষ্টা করাই বক্তৃতাসভার উদ্দেশ্য। কারো ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া এর লক্ষ্য নয়। এ ধরনের আলোচনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে উত্তম স্থান কী হতে পারে?’’
সাম্প্রতিক অতীতে বিশ্বভারতীর নানা কাজকর্মনিয়ে বিতর্ক হয়েছে। সমালোচনার মুখে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বিতর্ক হয়েছে বক্তৃতার বিষয় নির্বাচন নিয়েও। এর আগে সিএএ-এনআরসি নিয়ে আলোচনার আয়োজন করে সমালোচনার মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য বিজেপির খারাপ ফলের কারণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। তবে উপাচার্য তার বক্তৃতায় দাবি করেছেন, ‘‘বিশ্বভারতীর মূল ভাবনাকে আঘাত করা কালী বিষয়ক আলোচনার লক্ষ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শকে আমিই রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। ইচ্ছাকৃতভাবে আমার সম্পর্কে ভুল প্রচার করা হচ্ছে।’’
অন্যদিকে বিক্ষোভকারীদের দাবি, শান্তিনিকেতনের‘ট্রাস্ট ডিড' অনুযায়ী এটা স্পষ্ট, দেবেন্দ্রনাথ একেশ্বরবাদ ছাড়া অন্য ধর্ম বা মূর্তি নিয়ে চর্চা এখানে চাননি। তার আপত্তি ছিল ধর্মবিশেষের প্রতিমা বা চিহ্নের উপাসনাতেও। বীরভূমের বোলপুরে শান্তিনিকেতন চত্বরে পা রাখলে প্রথমেই নজরে আসে ব্রহ্ম উপাসনা গৃহ। এই প্রতিষ্ঠানে কালী আলোচনা অনভিপ্রেত বলে মনে করছেন ঠাকুর পরিবারের সদস্য, রবীন্দ্র বিষয়ক গ্রন্থের প্রণেতা সুপ্রিয় ঠাকুর। তিনি বলেন, "ধর্ম ও মূর্তিপুজো নিয়ে আলোচনা এর আগে কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। এ নিয়ে বক্তৃতাসভা হওয়া উচিত নয়। উপাচার্যের উচিত এই আলোচনা বন্ধ করা।”
বিশ্বভারতীর পঠনপাঠনের মান নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে৷ সেই প্রসঙ্গ টেনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, শিক্ষাবিদ ড. পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শাক্ত সাধনা নিয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে অনেক মৌলিক গ্রন্থ রয়েছে। তারপর কালী নিয়ে আলোচনা থেকে নতুন কী বেরিয়ে আসবে জানি না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তৃতার আয়োজন করা। সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সূচকে বিশ্বভারতী পিছিয়ে পড়েছে। সেদিকে মনোযোগ দিলে ছাত্র-ছাত্রীদের মঙ্গল৷’’