শতবর্ষে বিশ্বভারতী ঘিরে বিতর্ক
২৬ ডিসেম্বর ২০২০রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ও ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীর ১০০ বছর৷ প্রধানমন্ত্রী এই প্রতিষ্ঠানের আচার্য৷ শতবর্ষ অনুষ্ঠান সশরীরে শান্তিনিকেতনে না এলেও ভার্চুয়াল সভায় ভাষণ দেন তিনি৷ সেই ভাষণে উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর রবীন্দ্র প্রীতি৷ রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুজরাট বাসের কথা তুলে ধরেছেন মোদী৷ উঠে এসেছে তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কথা৷ সত্যেন্দ্রনাথ আহমেদাবাদে থাকাকালীন সেখানে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন৷ বেশ কিছুদিন সেখানে থাকার সময়ে কবি কতটা সাহিত্য চর্চা করেছেন তার আভাস দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মোদী৷ শুধু তাই নয় জ্ঞানদানন্দিনীর শাড়ি পরার ভঙ্গি বিশ্লেষণ করে বাংলা ও গুজরাটের সম্পর্ককে নতুন সূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন মোদী৷
এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷ ইদানীং বিজেপির শীর্ষ নেতারা বাংলার মনীষীদের উল্লেখ করছেন তাদের নানা বক্তৃতায়৷ বাঙালির আবেগকে আকর্ষণ করার জন্য তাদের এই উদ্যোগ বলে মত শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস বলেন, ‘‘গুজরাটের সঙ্গে বিশ্বকবির যোগাযোগ যেভাবে উঠে এসেছে, তাতে বিশ্বভারতীর থেকে দলীয় রাজনীতির কথা অনেক বেশি উঠে এসেছে৷ সমাবর্তনের মঞ্চে আচার্য হিসেবে পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিমা সম্পর্কে বলার বদলে কেন্দ্রের শাসকদলের দ্রোণাচার্যের ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন৷’’
সম্প্রতি বিজেপির অন্য রাজ্যের কয়েকজন নেতাকে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ তাদের বহিরাগত তকমা দিয়ে প্রচার শুরু করেছে তৃণমূল৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শাসকদলের কতটা নিবিড় যোগ, এটাই ‘গুজরাট মডেল’ ও ‘আত্মনির্ভর ভারত’ দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘সারা পৃথিবীতে বিশ্বভারতীর যে নাম এবং শান, তাতে রবীন্দ্রনাথ ও গুজরাট এই কথাটা কোনোভাবেই আসে না৷ তাছাড়া কবিগুরু স্বাদেশিকতা একেবারে চূড়ান্ত করে মানেননি৷ তিনি তথাকথিত জাতীয়তাবাদ তথা প্যাট্রিয়টিজমকে ঘেন্না করতেন৷ তার বহু লেখাতে সেটা বোঝা যায়৷ এবং তিনি সারা পৃথিবীতে সেটাই বলে বেড়িয়েছেন চিরকাল৷ জাতীয়তার বিরুদ্ধে তার একটা ক্রুসেড ছিল৷ সেটা কেউই বললেন না৷ শতবর্ষে বিশ্বভারতীতে সেই সূত্রটা ধরিয়ে দেওয়া দরকার ছিল৷ এমনকি রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী ভাবনার নাম করে বিশ্বভারতীর শতবর্ষের মঞ্চ যেভাবে মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত'-এর বিজ্ঞাপনের মঞ্চ হয়ে উঠেছে, তারও সমালোচনা করেছেন অধ্যাপক বিশ্বাস৷ অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাসের মতে, ‘‘যে ভাবনায় কবিগুরু শান্তিনিকেতনের স্থানীয় মানুষদের হাতের কাজ দেশ গড়ার জন্য ব্যবহারের কথা বলেছেন, তা স্বাধীনতার পর নেহেরুর আমল থেকেই আমাদের দেশে কাজে লাগানো হয়েছে বৈকি৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ভোট ময়দানে সেটা ব্যবহার করতে চাইছেন ‘ভোকাল ফর লোকাল' প্রসঙ্গে৷’’
ভোট ময়দানে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করতে কোনো শাসকদল কোনো অংশেই বাদ রাখেনি৷ বিশ্বভারতীর অনুষ্ঠানে সেটাও প্রমাণ হতে বকি নেই৷ রাজনীতির সূত্রে শতবর্ষের অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কেন তিনি অনুপস্থিত? তৃণমূলের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি৷ যদিও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী দাবি করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷ এমনকি সাংবাদিক বৈঠকে তৃণমূল নেতা তথা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রধানমন্ত্রীর ঠাকুর পরিবার সংক্রান্ত তথ্যের ভুল ধরেছেন৷ এভাবেই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চাপানউতোরে ভরপুর ছিল বিশ্বভারতীর শতবর্ষ পালনের অনুষ্ঠান৷ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘শতবর্ষের অনুষ্ঠানে সত্যিই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বভারতীর কী ভূমিকা, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন, ইংরেজ শাসনের ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিকল্প হিসেবে তিনি বিশ্বভারতীর চিন্তা করেন, তার উল্লেখ কোথায়? ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায় যে ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে ভালো কোনো উত্তর রেখে যেতে পারছি না আমরা৷’’ আপাতত সবার মনে একটাই প্রশ্ন, ভবিষ্যতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তচিন্তার পরিবেশ থাকবে তো?