1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বুলিং : মুক্তচিন্তার প্ল্যাটফর্মে ‘অসুস্থদের' আগ্রাসন

২৯ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশে অনুভূতিতে আঘাত দেয়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু কী করলে অনুভূতিতে আঘাত হবে তা আইনে স্পষ্ট করে বলা নেই। এ কারণে অনেকে ‘আঘাত' পেলেও বিচার পান না, আবার কেউ কেউ সেই আইন দিয়েই অন্যকে হয়রানি করেন।

https://p.dw.com/p/4eGEM
একটি ভবনের বারান্দায় বসে থাকা বিষণ্ণ নারীর ছবি
বাংলাদেশে অনুভূতিতে আঘাত দেয়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু কী করলে অনুভূতিতে আঘাত হবে তা আইনে স্পষ্ট করে বলা নেইছবি: Yuri Arcurs/Zoonar/IMAGO

এ বছর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন নটরডেম কলেজের ছাত্র আদনান আহমেদ তামিম। সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, "ঘুমানো, নামাজ, খাওয়া ছাড়া বাকি পুরো সময়ই লেখাপড়া করেছি।”  তার এই বক্তব্য নিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাংশ শুরু করেছেন তুমুল ট্রল। তাদের এই ট্রল রীতিমতো সাইবার বুলিংয়ের পর্যায়ে চলে যায়। তামিমকে নিয়ে হাসাহাসি, আপত্তিকর মন্তব্য, কথিত উপদেশসহ কোনো কিছুই বাকি থাকেনি।

তামিম সাবজেক্ট  হিসেবে সিএসই নিয়েছেন। এখন তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়িতে আছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আমাকে নিয়ে যারা ট্রল করেছেন তাদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। এটা নিয়ে আমি ভাবতেও চাই না। আমার লক্ষ্য পুরণে যা দরকার আমি তা-ই করেছি। এটাই আমার সফলতা।”

এটা তার ওপর কোনো মানসিক চাপ তৈরি করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমি এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমার এটা নিয়ে ভাবার সময় নাই।”

তার কথা, "তবে সার্বিকভাবে একেকজনের লাইফস্টাইল একেক রকম। চিন্তাও আলাদা। প্রত্যেকেরই নিজস্বতা আছে। সেটাকে সম্মান করা উচিত। আর ধর্ম পালন সবার করা উচিত বলে আমি মনে করি।”

তার পরিবারের সদস্যরাও সামাজিক মাধ্যমে তাকে নিয়ে ট্রল করার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না।

শুধু তামিম নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজস্ব চিন্তা বা লাইফ স্টাইল প্রকাশ করে অনেকেই ট্রল ও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন।

এর আগে শিশু  শিল্পী লুবাবাকেও রীতিমতো মানসিক নির্যাতন করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এক পর্যায়ে তার পরিবার তাকে অভিনয় থেকে দূরে রাখারও সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-র  গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)-র প্রধান যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদের সহায়তা নিতে হয়েছে। তারপরও যে তাকে নিয়ে ট্রল পুরোপুরি থেমেছে, তা বলা যাবে না।

একইভাবে অব্যাহত ট্রলের শিকার হয়েছিলেন অভিনেত্রী নুশরাত ফারিয়া তার কিছু ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনিও কথা বলতে রাজি হননি।

শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে: মুজিবুর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া তামিম প্রসঙ্গে বলেন, "সে রীতিমতো সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। তার ওপর সাইবার হামলা করা হয়েছে। একটি গ্রুপ তাকে ‘বাতিল মাল' হিসেবে ফেলে দিতে চেয়েছে। এখানে সে যদি খাওয়া আর ঘুমানোর কথা বলতো তাহলে হয়তো ওই গ্রুপটি কিছু বলতো না। নামাজ পড়ার কথা বলায় তারা তার বিরুদ্ধে লেগেছে।  আরেকটি গ্রুপ মনে করেছে তার মননশীলতার অভাব আছে। আসলে এখানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।”

তার কথা, "এখানেই সমস্যা। আমরা অন্যকে সম্মান জানিয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে অথবা ভিন্নমত প্রকাশ করতে শিখিনি। এটাও একটা মৌলবাদ, যে নিজের চিন্তাকেই ঠিক মনে করে অন্যের চিন্তাকে হেয় করা, অপমান করা। এটা আজকাল তথাকথিক শিক্ষিত লোকরাও করছেন।”

ইউনিসেফ সাইবার বুলিংয়ের সংজ্ঞায় বলছে, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে হয়রানি করার নামই সাইবার বুলিং। এটি সামাজিক মিডিয়া, মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম, গেমিং প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল ফোনে ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে যাদেরকে টার্গেট করা হয় তাদেরকে ভয় দেখানো, রাগিয়ে দেওয়া, লজ্জা দেয়া বা বিব্রত করার জন্য বার বার এরূপ আচরণ করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়- সামাজিক মাধ্যমে কারো সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়া বা বিব্রতকর অথবা অবমাননাকর ছবি পোস্ট করা।

মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্ষতিকর মেসেজ দেয়া বা হুমকি দেওয়া, অন্যের ছদ্মবেশ ধারণ করে তার পক্ষে আর একজনকে মেসেজ পাঠানো। ইউনিসেফ আরো বলছে, মুখোমুখি বুলিং এবং সাইবার বুলিং প্রায়শই পাশাপাশি ঘটতে পারে। তবে, সাইবার বুলিং একটি ডিজিটাল পদচিহ্ন রেখে যায়। এই ডিজিটাল পদচিহ্ন এমন একটি রেকর্ড, যা কার্যকর প্রমাণ হিসাবে কাজ করতে পারে এবং অপব্যবহার বন্ধে সহায়তা করতে প্রমাণ সরবরাহ করতে পারে।

ডিএমপির সাইবার ক্রাইম তদন্ত বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, "আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, কারুর মতের বা চিন্তার সঙ্গে মিল না হলে, অথবা রুচির সাথে না মিললে এই ট্রল বা বুলিংয়ের ঘটনা ঘটে। অনেকে আবার ফান করতে করতে এটা করেন। কেউ আবার বিকৃত রুচির কারণে এটা করেন। এটা সরাসরি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করেন। আবার কেউ ইনবক্সে, ফোনে, কমেন্ট বক্সে করেন। কেউ আবার সরাসরি পোস্ট দেন।”

অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিই: নাজমুল

"এটা অনেককেই বিপর্যস্ত করে। মানসিকভাবে এর শিকার হয়ে কেউ কেউ ভেঙে পড়েন। আমরা অভিযোগ পেলে সেটা বন্ধ করার চেষ্টা করি, কাউন্সেলিং করি। তারপরও প্রতিকার না হলে ক্ষতিগ্রস্ত আদালতে মামলা করতে পারেন.” বলেন তিনি।

তিনি জানান, এই সংক্রান্ত অনেক অভিযোগ তারা পান। নারীরাই এর বেশি শিকার হন। আবার অনেকে অভিযোগ না করে নিজেকে গুটিয়ে নেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ভীত-সন্ত্রস্তের জীবনযাপন করেন।

তরুণদের নিয়ে কাজ করা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন' বলছে, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে মোট ছয় জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের সবাই তরুণী।  তাদের কথা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই বুলিংয়েএর প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মকে কোনো দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা যাচ্ছেনা। ফেক আইডি ব্যবহার করে অধিকাংশ বুলিং হয়। কিন্তু এই ফেক আইডি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগই নেই ফেসবুকের, কারণ, এটা তাদের ব্যবসা। সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী তানসেন রোজ বলেন,"এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বডি শেমিংও বাড়ছে। কিন্তু এটাও যে অপরাধ, সেটা অনেকেই বুঝতে পারছেন না, বা জানলেও সেটা কেয়ার করছেন না।”

অনুভূতিতে আঘাত দেয়া একটি অসংজ্ঞায়িত বিষয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন (ডিএসএ)-তে অনুভূতিতে আঘাত দেয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেটা ধর্মীয় অনুভূতি হতে পারে। চিন্তার অনুভূতি হতে পারে। ব্যক্তিগত সম্মানের বিষয় হতে পারে। রাজনৈতিক হতে পারে।  কিন্তু আইনে এই অনুভূতির সংজ্ঞা নির্ধারণ করা নাই। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, "অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়েছে কিনা এটা আসলে আদালতই নির্ধারণ  করতে পারে। কারণ, আইনে বিষয়গুলো স্পষ্ট করা নেই। ফলে ডিএসএ'র সুবিধা নেন ক্ষমতাবানরা। তারা অন্যকে হেনস্তা করার জন্য এই আইনটি ব্যবহার করেন। সাধারণ মানুষ এই আইনে প্রতিকার পান না। তাদের প্রকৃতই অনুভূতিতে আঘাত করা হলেও তারা বিচার পান না।”

বাংলাদেশে বুলিংয়ের শিকার হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের মধ্যে মানসিক বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ তার পর্যবেক্ষণে বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এটা করা সহজ। তাই এর সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, "আমার কাছে এই ধরনের সমস্যা নিয়ে যারা আসছেন তাদের অধিকাংশই তরুণী।”

কিন্তু অনুভূতিতে আঘাতের আবার অপব্যাখ্যাও আছে বলে মনে করেন, এই মনোচিকিৎসক। তার মতে," অনুভুতি একটি অস্বচ্ছ বিষয়। অন্যকে আঘাত না করে আমি আমার মত প্রকাশ করতে পারবো। আবার  আঘাত না করে, অপমান না করে আমি কোনো মতের বিরোধিতাও করতে পারবো। এটাই সভ্য সমাজের নিয়ম। কিন্তু আমাদের এখানে অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে স্বাধীন চিন্তাও দমন করা হয়। সেটা রাজনৈতিক, ধর্মীয় নানা ধরনের অনুভূতি হতে পারে।”

স্বাধীন চিন্তাও দমন করা হয়: হেলাল

তার কথা, "এই স্বাধীন মত প্রকাশের নামে আবার যখন অন্যকে হেয় করা হয়, অপমান করা হয়, ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয় সেটা কিন্তু বুলিং। এখানেই অনুভূতিতে আঘাতের প্রশ্ন আসে।”

মনজিল মোরসেদ বলেন, " এখানে বাকস্বাধীতার প্রশ্ন আছে।  দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতিবাজ বলা যাবে না, আইনটি কিন্তু সেজন্য নয়। আইনটি হলো, কাউকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যাকে অপমান, অপদস্থ না করা হয় তার জন্য। কিন্তু ব্যবহার হচ্ছে উল্টো। যাদের ক্ষমতা আছে, তারা এটাকে তাদের অপরাধ ঢাকতে এবং সেটা যারা প্রকাশ করে, তাদের শাস্তি দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে যারা সাইবার বুলিং করে, তাদের সুবিধা হয়।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, "সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরিচিতরাও কারো ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারেন। এটার সুযোগ নিচ্ছে কেউ কেউ। তারা তাদের মতের বিরুদ্ধে, চিন্তার বিরুদ্ধে কিছু হলেই সেখানে গিয়ে যা খুশি তাই বলছেন, অপমান করছেন। শ্রদ্ধাবোধের বিষয়টি আর থাকছে না। ফলে মুক্ত চিন্তার পরিবর্তে এই প্ল্যাটফর্মকে তারা মুক্ত চিন্তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।”

নিজেকে জাহির করা বা কোনোভাবে প্রকাশ করার প্রবণতাও এখানে কাজ করে। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা, লেখা একটা যোগ্যতার বিষয়। এটা যারা করেন, তারা তাদের কাজের মধ্য দিয়েই করেন। কিন্তু ওই শ্রেণির মানুষ সেটা না পেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিকৃত পোস্ট বা মন্তব্য করে নিজেকে জাহির করে। বাস্তব জগতে কিন্তু তাদের গ্রহণযোগ্য অবস্থান নেই। এই মন্তব্য মনজিল মোরসেদের।

"আর শিক্ষার অভাব বিশেষ করে প্রযুক্তি ব্যবহারের শিক্ষা বা নেটিকেট একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটা যাদের মধ্যে নেই, তারা বুলিং বা ট্রল করেন। এটা পাড়ার কিছু ছেলে যেমন দল বেঁধে উত্যক্ত করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাই। আর একই মানসিকতার লোক একজনকে দেখে আরেকজন উৎসাহিত হয়। তারা দলবদ্ধ হয়।,” বলেন তানসেন রোজ।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য