২০১৮ সাল। তখন পশ্চিমবঙ্গে একটি প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকার কর্মী হিসেবে রিপোর্টিং করি। সেপ্টেম্বর মাসে পর পর দুইটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে পাতাজোড়া রিপোর্ট বার হলো। তা দেখে সম্পাদক মহাশয়ের চক্ষুচড়কগাছ। কেন আমরা সেই খবর পাইনি, তা নিয়ে দীর্ঘ চোটপাটের পর স্থির হলো, নতুন অ্য়াঙ্গেলে এই স্টোরি আমাদের ধরতে হবে।
কলকাতা থেকে কয়েকঘণ্টার দূরত্বে বারুইপুর লাগোয়া হারদা গ্রামে পৌঁছানো গেল। সেখানে একটি ব্যক্তিগত জমিতে বাঁশের ঘর বেঁধেছেন সাকুল্যে ৪০ টি রোহিঙ্গা পরিবার। মূলত দিল্লি এবং জম্মু থেকে পশ্চিমবঙ্গ এসেছেন তারা কিছু কাজের খোঁজে। আর পাঁচটি উদ্বাস্তু পরিবারের মতোই দিন কাটছে তাদের। ২৫-২৬টি পরিবারের কাছে ইউএনএইচসিআর-এর রিফিউজি কার্ড ছিল। বাকিরা দরখাস্ত করেছেন। যত মানুষ সেই ক্যাম্পে ছিলেন, তার ৫০ ভাগ নারী, ১৫ ভাগ শিশু এবং বাকি পুরুষ। এর মধ্যে শয্যাশায়ী বৃদ্ধ পুরুষের সংখ্যা অন্তত ১০।
অথচ জাতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এই সব কোনো সংখ্যাতত্ত্বে না গিয়ে সরাসরি লিখে দিয়েছিল, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্প তৈরি হওয়ার পর এলাকায় অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পার করে তারা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকছেন এবং অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। অথচ বিএসএফ এই সাংবাদিককে অন রেকর্ড জানিয়েছিল, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই রোহিঙ্গারা অধিকাংশই ভারতের অন্য জায়গা থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছেন। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো যোগ নেই। রীতিমতো রেকর্ড খুলে বিএসএফ দেখিয়েছিল, এক বছরে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ৭০ জন রোহিঙ্গা ঢুকেছেন।
তাহলে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ এবং অপরাধ শব্দ দু'টিকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কেন জড়িয়ে দেওয়া হলো? কয়েক মাসের মধ্যেই তা স্পষ্ট হলো।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে কেন্দ্রীয় শাসকদলের নেতারা বার বার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ এবং রোহিঙ্গা শব্দ দুটিকে মিলিয়ে দিচ্ছিলেন। এবং তার সঙ্গেই জুড়ে দেয়া হচ্ছিল 'অপরাধ' শব্দটিকে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে অপরাধ জগতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা। এবং তারা নাকি সকলেই বাংলাভাষী! অপরাধ করতেই তারা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে।
ওই ঘটনার পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। আবার এক লোকসভা ভোটের মুখোমুখি আমরা। এবং আবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে রোহিঙ্গা শব্দটি। সম্প্রতি তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তল্লাশি চালাতে যায়। শাহজাহানের অনুগামীরা তাদের উপর চড়াও হয়। মারধর করা হয় সিআরপিএফ এবং ইডি কর্মকর্তাদের। মারধর করা হয় সাংবাদিকদেরও। এরপর থেকে শাহজাহান নিরুদ্দেশ। ইডি আবার তার বাড়ি গেছে তল্লাশি করতে। পুলিশ শাহজাহানকে খুঁজছে। বলাই বাহুল্য, বাহুবলী শাহজাহান এমন কাণ্ড এর আগেও একাধিকবার ঘটিয়েছে। এর আগেও তাকে গা ঢাকা দিতে হয়েছে খুনের অভিযোগে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সুন্দরবনের এক প্রান্তিক অঞ্চল সন্দেশখালি। শাহজাহানকে ওই অঞ্চলের বেতাজ বাদশাহ বলা চলে। তার 'গুন্ডামি'র ইতিহাস কয়েক দশকের। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে শাহজাহান সেই দলের বাহুবলী হয়ে ওঠে। শোনা যায়, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকেও তার সেফ হাউস আছে। কাঁটাতার, বিএসএফ পেরিয়ে কীভাবে সে সীমান্ত পার করে, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না।
রাজনীতি নিজস্ব কয়েনেজ আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। শাহজাহান এবং রোহিঙ্গা মেলাতে পারলেই রাজনীতির কেল্লা ফতে। তাই আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল ওই ঘটনার পরেই বিজেপির রাজ্য এবং কেন্দ্রের নেতারা একের পর পোস্ট করতে শুরু করলেন সমাজমাধ্যমে। সেখানে বলা হলো, শাহজাহানের দলে আছে ভয়াবহ রোহিঙ্গা অপরাধীরা। প্রশ্ন হলো, এই রোহিঙ্গাদের শাহজাহান পেলেন কোথা থেকে? রাজনীতিবিদেরাই বা জানলেন কী করে এখবর? যদি বা জানলেন, আইনানুগ ব্যবস্থা নিলেন না কেন? রোহিঙ্গা চিহ্নিত করা এবং তাকে জেলে ঢোকানো মোটেই কঠিন কাজ নয়।
বাস্তবে, সন্দেশখালি অঞ্চলে কোনোদিনই রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছিল না। বারুইপুর অঞ্চলে যে ক্যাম্প ছিল, তা বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ওই ক্যাম্পের অনেকেই দিল্লি লাগোয়া হরিয়ানার নু, জম্মু এবং দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমানা লাগোয়া ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এই প্রতিটি ক্যাম্পই ভারতের রোহিঙ্গা ক্যাম্প হিসেবে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত। বস্তুত, ২০২১-২২ সালে ওই ক্যাম্পগুলি ঘুরে দেখার সময় বেশ কিছু পুরনো মুখের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পে যাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
ভারত সরকার কখনোই মিয়ানমার থেকে উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভারতে থাকার অনুমতি দেয়নি। বাংলাদেশে যে পরিমাণ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বসবাস করেন, তার সিকিভাগও ভারতে নেই। ভারতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ক্যাম্পের সংখ্যা হাতে গুণে বলে দেওয়া যায়। সেই ক্যাম্পে যারা বসবাস করেন, তারা কার্যত 'খোলা জেলে' থাকেন। বাইরে থেকে তাদের সঙ্গে সাংবাদিকেরা দেখা করতে গেলেও থানায় গিয়ে জানিয়ে আসতে হয়। রোহিঙ্গা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য থানার অনুমতি লাগে। বাইরে গিয়ে কাজ করার অনুমতি নেই তাদের। কিছু এনজিও ক্যাম্পের চৌহদ্দির মধ্যে তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।
এরপরেও কি কেউ বাইরে যান না? পরিচয় গোপন করে অনেকেই অনেক কাজ করেন বলে শোনা যায়। কেউ কেউ অপরাধও করেন। জেলেও যান। কিন্তু তার সংখ্যা কত? সার্বিকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অপরাধপ্রবণ এমন কোনো তথ্য সরকারি নথিতে আছে কি? উত্তর, নেই।
কিন্তু রাজনীতিতে আছে। ভারতের দক্ষিণপন্থি রাজনীতি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অপরাধের একটি আশ্চর্য সমান্তরাল তৈরি করে ফেলেছে। জনমানসে সেই বার্তা গেঁথে দেয়া গেছে। ফলে সুযোগ পেলেই রাজনীতি রোহিঙ্গা জুজু জনমানসে ছড়িয়ে দেয়। বাস্তবের সঙ্গে যার কার্যত কোনো সম্পর্ক নেই। এই জনমানস জানেই না, রোহিঙ্গারা কোন ভাষায় কথা বলেন?
ফিরে আসা যাক শাহজাহানের এলাকায়। সুন্দরবন অঞ্চলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত সন্দেশখালি বরাবরই অপরাধপ্রবণ এলাকা। গরু-মানুষ-মাদক পাচারের জন্য কুখ্যাত এই এলাকা ডাকাতি-রাহাজানিরও তীর্থক্ষেত্র। ভারত-বাংলাদেশের একাধিক ক্রসবর্ডার গ্যাং এখানে মাফিয়ারাজ চালায় বলে অভিযোগ। শেখ শাহজাহানের মতো বাহুবলীরা এই সমস্ত গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত বলে শোনা যায়। চোখ-কান খোলা রাখলে তার আভাসও মেলে। শাহজাহানের ডেরায় গিয়ে তাদের অস্ত্রসম্ভার দেখে এসেছে এই সাংবাদিক। কিন্তু রোহিঙ্গাদের খোঁজ পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। বাংলাদেশের যে অঞ্চলে রোহিঙ্গা শিবির বা রোহিঙ্গাদের যাতায়াত, তার চেয়ে বহু বহু কিলোমিটার দূরে এই সন্দেশখালি।
কিন্তু কে না জানে, রাজনীতির না আছে ভূগোল, না আছে ইতিহাস! মানবমনে উত্তেজনা তৈরির বিকৃত তথ্য বরাবরই রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র। ভারতে 'রোহিঙ্গা' শব্দটি তেমনই এক বিকৃত রাজনৈতিক অস্ত্র।