মমতা কি পারবেন?
২৭ আগস্ট ২০২১এর আগে একবারই সুযোগ এসেছিল। সেই ১৯৯৬ সালে। যখন সিপিএম সম্মতি দিলেই জ্যোতি বসু দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বসে জ্যোতি বসুকে দেখতে হয়েছিল, কেমন করে তার সামনে আসা এই সুবর্ণ সুযোগ হাত ফসকে চলে গেল। তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে দিলেন না দলের কট্টর কিছু নেতা, যাদের মনে হয়েছিল, জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে লাভ নেই। তাতে দলের কর্মসূচি রূপায়ণ করা সম্ভব হবে না। জ্যোতি বসু পরে যে সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক ভুল বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর ৭৫ বছরে বাঙালির পক্ষে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদ ওই একবারই হাতের নাগালে আসা পাকা ফলের মতো ঝুলছিল। হাতে তুলে নেয়ার অপেক্ষা ছিল। কিন্তু এত কাছে এসেও জ্যোতি বসুর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হয়নি। তার আগে বা পরে পশ্চিমবঙ্গের কোনো নেতার ভাগ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
তবে প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হতে পেরেছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতা কার্যত নেই। ভারতে ক্ষমতার আসল চাবিকাঠি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সেখানে প্রণবের প্রবেশ ঘটার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বরং ইন্দিরা গান্ধী তার দেহরক্ষীর হাতে মারা যাওয়ার পর সেসময় পশ্চিমবঙ্গ সফররত রাজীব গান্ধী যখন বিশেষ বিমানে দিল্লি ফিরছিলেন, তখন সেখানে প্রণবও ছিলেন। সেই বিমানে তার কাছ থেকে এরপর কী হবে সেটা জানতে চাওয়া হয়। প্রণবের জবাব থেকে রাজীব ঘনিষ্ঠদের মনে হয়েছিল, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। তার জেরে প্রণবকে মন্ত্রিসভায় নেননি রাজীব। তারপর কংগ্রেস থেকেই সাসপেন্ড হন। পরে তিনি কংগ্রেসে ফিরে মনমোহন সিং মন্ত্রিসভার দুই নম্বর ব্যক্তি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের বিজেপি-কে হারিয়ে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজর এখন দিল্লির দিকে। তিনি যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিরোধীদের নেতৃত্ব দিতে চান এবং জিতলে প্রধানমন্ত্রী হতে চান, সেটা তার দল খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছে। কিছুদিন আগে মমতা যখন দিল্লি এসেছিলেন, তখন সংসদীয় দলের বৈঠকের পর জানানো হয়েছিল, একমাত্র মমতাই মোদীকে হারাতে পারেন। তিনিই বিরোধীদের একজোট করে লড়াই করতে পারেন। তিনিই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যোগ্যতম বিরোধী নেতা। আবার এক বাঙালি রাজনীতিকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
লক্ষ্যপূরণের চেষ্টা
মমতা জানেন, তার ইচ্ছেপূরণের রাস্তা মোটেই সহজ নয়। বরং সেই পথে কাঁটা প্রচুর। তার সাফল্য বলতে, তিনি পশ্চিমবঙ্গে প্রথমে বামেদের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। তারপর প্রবল প্রতাপান্বিত বামকে একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনতে পেরেছেন। এবার তাকে হারাতে মোদী-শাহ সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মমতাকে হারাতে পারেননি। বামেদের হারানোর পর মোদী-শাহকে হারানো মমতার কাছে খুবই উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সাফল্য। তারপরেই তার নাম সর্বভারতীয় রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা কতটা তা নিয়ে বিচার-বিবেচনাও হয়েছে ও হচ্ছে জাতীয় মিডিয়াতে।
এটা নিঃসন্দেহে মমতার কাছে সুখবর। জ্যোতি বসুর পর আবার পশ্চিমবঙ্গের একজন রাজনীতিক জাতীয় পর্যায়ে এতটা গুরুত্ব পাচ্ছেন। কিন্তু মমতার অন্যতম দুর্বলতা হলো, তিনি মাত্র একটি রাজ্যে ক্ষমতায়। তার দলের অন্য কোনো রাজ্যে তেমন কোনো প্রভাব নেই। তাই তৃণমূলকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় দলে পরিণত করতে মমতা উঠে পড়ে লেগেছেন। ভারতে একটি দল তখনই জাতীয় দল হিসাবে স্বীকৃতি পায়, যখন তারা তিনটি রাজ্যে দুই শতাংশ লোকসভা আসনে জেতে অথবা তারা চারটি লোকসভা আসন পায় এবং চারটি বা তার বেশি রাজ্যে লোকসভা বা বিধানসভা ভোটে ছয় শতাংশের বেশি ভোট পায় অথবা চারটি রাজ্যে তারা রাজ্য দলের স্বীকৃতি পায়। এজন্যই মমতা এখন ত্রিপুরা, আসাম সহ উত্তর পূর্ব এবং কেরালায় তৃণমূলকে ছড়িয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এর মধ্যে ত্রিপুরায় তৃণমূল কিছুটা হইচই ফেলেছে। ত্রিপুরা বাংলাভাষী বলে সেখানে তৃণমূলের সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা তুলনায় বেশি। আসামেও বাংলাভাষী এলাকায় তারা প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সন্তেষমোহনের মেয়ে সুস্মিতা দেব সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
এখনো পর্যন্ত তৃণমূলের বিস্তারের চেষ্টা বাংলাভাষী এলাকায় বেশি হয়েছে। কিন্তু ভারতের জাতীয় রাজনীতিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে হিন্দি-বলয়, যার মধ্যে পড়ছে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলি। সেখানে মমতার এখনো কোনো সংগঠন বা প্রভাব নেই। সেখানকার মানুষের মমতা সম্পর্কে কৌতূহল আছে ঠিকই, কিন্তু তৃণমূলনেত্রী সেখানে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেননি। যেমন পারেননি গুজরাট, মহারাষ্ট্রের মতো প্রবাবশালী দুই পশ্চিম ভারতের রাজ্যে অথবা দক্ষিণ ভারতের কোনো রাজ্যে। এটাই তার সব চেয়ে বড় দুর্বলতা।
এখনো সর্বভারতীয় রাজনীতিতে অন্য বিরোধী দলের থেকে কংগ্রেসের প্রভাব অনেক বেশি। মরা হাতি লাখ টাকার প্রবাদটা কংগ্রেসের ক্ষেত্রে খাটে বেশি। তাই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোট এখনো সম্ভব নয়। মমতাও সেটা বোঝেন বলে দিল্লিতে গিয়ে সোনিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে এসেছেন।
মমতার কৌশল
এই দুর্বলতা ঢাকতে মমতা দ্বিমুখি কৌশল নিয়েছেন। প্রথমত, তিনি জানেন ২০২৪ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তিনি খুব বেশি হলে এক-দুইটি আসন পেতে পারেন, তার বেশি নয়। ফলে এই বাস্তবতাকে নিয়ে তাকে এগোতে হবে। তাই তার প্রস্তাব হলো, আগে আঞ্চলিক দলগুলি জোটবদ্ধ হোক। তারপর কংগ্রেস তাদের সমর্থন করুক। আঞ্চলিক বিজেপি বিরোধী দলের মধ্যে আছে শরদ পাওয়ারের এনসিপি, মুলায়মের সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতীর বিএসপি, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, হেমন্ত সোরেনের জেএমএম, কেজরিওয়ালের আপ, স্ট্যালিনের ডিএমকে, কেসিআরের টিআরএস, জগনমোহনের ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বাম দলগুলি এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দল। দ্বিতীয়ত, সংসদের ভিতর তৃণমূল সব চেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিল। সেই সঙ্গে মমতাকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একটা প্রচারও শুরু হয়েছে। যাতে মানুষের মনে কথাটা চলে যায়।
মমতা এই সব দলের জোট চাইছেন। তিনি চেয়েছিলেন, তিনি দিল্লিতে থাকার সময় বিরোধী দলগুলি একবার বৈঠকে বসুক। কিন্তু সেই বৈঠক হয়নি। শরদ পাওয়ার দিল্লিতে থাকলেও মমতার সঙ্গে দেখা করেননি। কেজরিওয়াল ও ডিএমকে-র কানিমোরিকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো দলের নেতা তার সঙ্গে দেখা করেননি। ফলে আঞ্চলিক দলগুলি এখনই তাদের তাস ফেলতে রাজি নয় তা বোঝা যাচ্ছে।
উল্টে রাহুল গান্ধী এখন খুবই সক্রিয় হয়ে গেছেন। সংসদ চলার সময় তিনি বিরোধীদের বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে সব দলের নেতারা যোগ দিয়েছেন। বিভিন্ন রাজ্য নিজের দলের বিরোধ মেটানোর চেষ্টাও তিনি শুরু করেছেন। ফলে কংগ্রেস যে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর অনেকগুলি আঞ্চলিক দল এখন বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের জোটসঙ্গী। ফলে তারা কংগ্রেসের দিকে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বিজেপি চায়
বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গে মমতাকে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছে। সেই সঙ্গে এমন কিছু বিষয় তাদের সামনে আছে, যা দিয়ে তারা তৃণমূল নেত্রীর ভাবমূর্তিতে আঘাত হানা যাবে বলে মনে করছে। যার মধ্যে একটি হলো ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনা। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই এখন এর তদন্ত করছে। এছাড়াও ভবিষ্যতে আন্দোলনের কর্মসূচিও তাদের ছকে নেয়া আছে। তাছাড়া মমতা মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন কি না তা নির্ভর করছে নভেম্বরের মধ্যে রাজ্যে উপনির্বাচন হয় কি না তার উপর। করোনা পরিস্থিতি খারাপ থাকলে নির্বাচন কমিশন ভোট করার ঝুঁকি নাও নিতে পারে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী না থাকলে তখন পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি করে সক্রিয় হবে বিজেপি।
তবে বিজেপি-র কাছে এখন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উত্তর প্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখা। এখন তালেবান-জুজুকে সামনে রেখে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যগুলিতে আসন্ন ভোটে জেতার কৌশল সাজাচ্ছে বিজেপি। উত্তর প্রদেশে তারা জিতে গেলে, সেটা হবে বিরোধীদের কাছে খুব বড় ধাক্কা।
মমতা কি পারবেন?
এই প্রশ্নের জবাব সহজ নয়, অন্ততপক্ষে এই সময়ে। কোনো সন্দেহ নেই, মমতার সামনে একটা সুযোগ এসেছে। তিনি সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে গিয়েছেন। তার নাম নিয়ে ভারতে আলোচনা হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন এক বঙ্গসন্তান। এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও ঘটনা, তাকে প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে। পরের লোকসভা ভোট হবে ২০২৪ সালে। এখনো তিন বছর দেরি আছে। রাজনীতিতে তিন বছর অনেক সময়। তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আর রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কোনো কথা নেই। তাই মমতা পারবেন কি না, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তা নির্ভর করছে, তার ভবিষ্যত কর্মপন্থার উপর, মোদী-শাহের বিরোধিতা কংগ্রেস সহ অন্য দলগুলি কতটা করতে পারে তার উপর এবং একসময় দেবগৌড়া, গুজরালের মতো নেতা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ফলে মমতা হতে পারবেন না এমন কথা বলা যাবে না। কিন্তু তার লড়াই মোদী-শাহের বিরুদ্ধে। বর্তমান ভারতের রাজনীতিতে এই দুই ধুরন্ধর প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিজের রাজ্যে তিনি হারিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাদের হারানোটা অনেক কঠিন খেলা।