জলনগরী
১৯ অক্টোবর ২০১২সত্যি কথা বলতে কী, কোয়েন ওলথুইস স্বপ্ন দেখতেন আগে, এখন তো ধীরে ধীরে স্বপ্নের তরীটাকে তীরে ভেড়ানোর লক্ষ্যে এগোচ্ছেন৷ এক ফুঁ দিয়ে সবার সব সমস্যা দূর করে দেবো – এমন কল্পনা তো সবাই করতে পারে৷ স্থপতি ওলথুইসের স্বপ্নটা একটুও বাস্তবতাবর্জিত নয়৷ পৃথিবীতে আশ্রয়হীনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে৷ অচিরে কিছু না করতে পারলে সংখ্যাটা আরো বাড়বে৷ কিন্তু মুশকিল হলো, বাসযোগ্য জমি তো বাড়ছে না৷ বাড়ছে শুধু জনসংখ্যা৷ তাহলে?
জন্মসূত্রে ডাচ বলে ওলথুইস এর একটা সমাধানসূত্র জানেন৷ তাঁর দেশের নামই তো নেদারল্যান্ডস, যার অর্থ ‘নীচু দেশ'৷ দেশটির শতকরা ২০ ভাগ ভূমি আর ২১ ভাগ মানুষের আবাসই সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে৷ নেদারল্যান্ডস তাই জানে সাগরের বুকে বাস করেও কিভাবে নিরাপদ থাকা যায়৷ ৫০০ বছর ধরে চলছে সর্বনাশা সাগরের হাত থেকে তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই৷ সাফল্য আশ্চর্যজনক৷ রাজধানী আমস্টারডামের কথাই ধরুন না! এর নামকমরণ হয়েছে আমস্টেল নদীতে দেয়া ‘ড্যাম' অর্থাৎ বাঁধের কথা মনে রেখে৷ নয়'শ বছর আগে যেখানে ছিল স্রেফ একটা জেলেদের গ্রাম, সেখানে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী, ভাবা যায়! আমস্টেল নদীতে বাঁধ না দিলে কিন্তু এটা কখনো সম্ভব হতো না৷
নদীতে বাঁধ দিয়ে জনবসতি গড়া বা নগর রক্ষা করার চেষ্টা – এসব এ যুগে আর অভিনব কিছু নয়৷ কিন্তু সাগরতীরে তো এই কৌশলে সফল হওয়া অসম্ভব৷ তাই মালদ্বীপ সহযোগীতা চেয়েছে ওলথুইসের প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াটার স্টুডিয়ো'-র কাছে৷ ওয়াটার স্টুডিয়ো অনেক দিন ধরেই করে আসছে ভাসমান ঘর তৈরির কাজ৷ বড় বড় এমন ঘর তৈরি করে তারা যাতে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকে, পাশে রাস্তা থাকে, থাকে আধুনিক জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য প্রায় সব সুব্যবস্থা৷ যারা এমন ঘর তৈরি করতে পারে তাদের পক্ষে একটা ভাসমান দ্বীপ তৈরিও সম্ভব – এমন ভাবনা থেকেই নেদারল্যান্ডসের এক নাগরিকের সাহায্য চেয়েছে মালদ্বীপ৷ ওলথুইস জানালেন সেই অনুরোধের কারণেই নাকি ভাসমান নগরী গড়ার ভাবনাও শেকড় গেড়ে বসে তাঁর মাথায়, ‘‘সমুদ্রপৃষ্ঠ দিন দিন ওপরের দিকে উঠতে থাকায় মালদ্বীপ একসময় নিশ্চিহ্নও হয়ে যেতে পারে৷ এ কারণেই ওরা আমাদের ভাসমান দ্বীপের ডিজাইন তৈরির কথা বলে৷ ওদের অনুরোধটার পর থেকে আমরাও পুরোদমে কাজ শুরু করেছি৷''
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ওলথুইসের কাজের সুনাম আছে৷ ক্যারিয়ারের শুরুতে বড় বড় বজরা নৌকা তৈরি করতেন৷ নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশেই দেখা যায় পুরোদস্তুর একটা বাড়ির সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন এমন নৌকা৷ পরে ডাচ ডকল্যান্ডসের সঙ্গে মিলে দুবাইয়ের পাম আইল্যান্ড উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বড় বড় ভাসমান বাড়ির ডিজাইন করে দিয়ে দেশের বাইরেও বেশ পরিচিত পান তরুণ স্থপতি কোয়েন ওলথুইস৷ পরিচিতি বাড়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করার সুযোগও এসেছে বেশ কিছু৷ ভারত এবং চীনের কিছু প্রকল্পের কাজও করছে তার ওয়াটার স্টুডিয়ো৷ মালদ্বীপের অনুরোধে ১৮৫টি বিলাসবহুল ভাসমান ভিলা নিয়ে একটি অভিজাত আবাসিক এলাকার ডিজাইন তৈরির কাজ শেষ৷ এলাকাটির নাম দিয়েছেন ‘ওশান ফ্লাওয়ার' বা মহাসমুদ্রের ফুল৷ এখন চলছে ১২০০ ঘরের একটা এলাকার নকশা তৈরির কাজ৷ তা ১২০০ ঘর নিয়ে গড়া এলাকাটাকে তো ছোট্ট একটা ভাসমান নগরী বলা যেতেই পারে, কি বলেন?
এমন নগর তৈরির ভাবনাটা কোয়েন ওলথুইসের মনে এসেছে বাংলাদেশের মতো কিছু দেশের কারণে৷ নানা ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে বণ্যায় প্রায়ই বাংলাদেশে বিপর্যয় নেমে আসার খবর বেশ ভাবায় তাঁকে৷ বেশি ভাবায় হতদরিদ্র মানুষদের অবর্ণনীয় কষ্ট৷ এ কষ্ট থেকে মুক্তির পথই দেখাচ্ছেন ওলথুইস৷ নেদারল্যান্ডসে তো কবে থেকেই সাগরের ঢেউয়ে ভাসছে ভাসমান অসংখ্য ঘর৷ তা ঘর যদি ভাসতে পারে, কিছু ঘর নিয়ে গড়া একটা নগরী কেন নয়? ওলথুইস বলছিলেন, ‘‘দেখুন, নগরায়ন এবংজলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর সব বড় নগরীতেই এখন খোলা জায়গার অভাব প্রকট হয়ে উঠছে৷ আমরা কিন্তু পানিতেই খোলা জায়গার কথা ভাবতে পারি৷''
খুব সহজ সমাধান৷ তা পানিতে নগরী গড়া কি সম্ভব? ওলথুইসের উত্তর, ‘‘অবশ্যই''৷ তারপরই পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘এলিভেটর আবিষ্কার না করলে আজও কি আমরা ৪-৫ তলার চেয়ে বেশি উঁচু বাড়ি দেখতাম?'' ডাচ এই স্থপতি মনে করেন সাগরের বুকে ভাসমান নগরী গড়লে মানুষ তখন জলের সঙ্গে আর যুদ্ধ করবে না, বরং শান্তিতে বসবাস করবে৷
এসিবি/ডিজি (রয়টার্স)