মাটি মনে রাখবে মমতাকে!
১ সেপ্টেম্বর ২০১৬পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর ছোট গাড়ির কারখানার জন্য এক হাজার একর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করেছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার৷ কিন্তু বেঁকে বসেছিলেন সিঙ্গুরের কৃষকদের এক অংশ৷ পরিষ্কার বিভাজন হয়ে গিয়েছিল জমি দিতে ইচ্ছুক এবং অনিচ্ছুক কৃষিজীবীদের মধ্যে৷ ইচ্ছুকরা বিশ্বাস রেখেছিলেন বামফ্রন্ট প্রবর্তিত স্লোগানে — ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যত'৷ আর অনিচ্ছুকরা মনে করেছিলেন, তাঁদের মতামতের তোয়াক্কা না করে, জোর করে চাষের জমি কেড়ে নিচ্ছে সরকার৷
ফলে গড়ে উঠেছিল ভূমিরক্ষার এক জোরদার আন্দোলন৷ সারা দেশের সমাজকর্মী, রাজনৈতিক শক্তি এবং সংবাদমাধ্যমের নজর সেই দিকে ফিরেছিল যখন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করলেন৷ প্রথমে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে অবস্থান বিক্ষোভ, অনশন৷ তারপর কলকাতায় মমতার লাগাতার অনশন৷ মমতার সোজা কথা ছিল, শিল্পের প্রয়োজনে হোক, বা অন্য যে কোনো প্রয়োজনে, সেটা যদি সড়ক, রেলপথ, বা নদীবাঁধ তৈরির আবশ্যিক দরকারেও হয়, কৃষকের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁদের জমি কেড়ে নেওয়া যাবে না৷
৩১ আগস্ট ২০১৬ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই নীতিগত অবস্থানেই আইনি সিলমোহর দিল৷ জানিয়ে দিল, সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানার জন্যে সরকারের কৃষিজমি অধিগ্রহণ অবৈধ, কারণ, সংশ্লিষ্ট কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের সম্মতি নেওয়া হয়নি৷ সোজা কথায়, সরকার গায়ের জোরে চাষের জমি কেড়ে নিয়েছে৷ বামফ্রন্ট সরকার যে সেটা করেছিল, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ই সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, টাটাদের হাতে কারখানার জমি তুলে দিতে সরকার তাড়াহুড়ো করেছিল৷ সে সময়ের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা বলেও ফেলেছিলেন, সিঙ্গুরের কৃষিজমি যে অধিগ্রহণ করা হবে, সে নিয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি সরকারের৷ তিনি কিছু জানতেনই না! কেন দোফসলা, তিনফসলা কৃষিজমিই গাড়ি কারখানার জন্যে নেওয়া হবে, কেন অন্য জমি নয়, সে প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দেননি৷ বরং ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর সেই দম্ভোক্তি — ‘‘টাটাদের কেশাগ্র কাউকে স্পর্শ করতে দেব না!''
পরিণতিতে যেটা হলো, গোটা বামফ্রন্টেরই মাথা মুড়িয়ে গেল পরের বিধানসভা নির্বাচনে৷ ৩৪ বছরের বামশাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এই পালাবদলের সূচনা হয়েছিল ওই সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন থেকেই৷ কাজেই সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায় মমতারই রাজনৈতিক এবং নৈতিক জয়, যা সম্ভবত গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের একক সাফল্যের চেয়েও বড় ঘটনা হিসেবে লেখা থাকবে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে৷ কিন্তু ভবিষ্যতে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হবে, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাব৷ জমির মালিকের সম্মতি ছাড়া এমনকি সরকারও যে তাঁর জমি কেড়ে নিতে পারে না, এই মৌলিক অধিকারের আইনি স্বীকৃতি নিশ্চিত করছে সিঙ্গুর মামলার রায়৷ এবং আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যেরকম একটি দৃষ্টান্ত পরবর্তী সিদ্ধান্তকে রাস্তা দেখায়, এমন হতেই পারে যে সারা দেশ জুড়ে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে একের পর এক আইনি লড়াই শুরু হলো৷
তাতে যেটা হবে, হয়ত অনেক প্রকল্পের কাজ সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যাবে, কিন্তু ভবিষ্যতে এ ধরনের যে কোনো প্রকল্পের চিন্তাভাবনা করার সময় সাধারণ মানুষের ইচ্ছে, মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে৷ কোনো শিল্পগোষ্ঠী পারবে না স্রেফ অর্থের জোরে, রাজনৈতিক দল পারবে না ক্ষমতার জোরে ব্যক্তিমানুষের অধিকারকে দমিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে!
যাঁরা আজ বলছেন, আদালতের এমন রায়, ভবিষ্যতে শিল্প বিনিয়োগের রাস্তা আটকাবে, তাঁরা তাই ঠিক বলছেন না৷ বরং উল্টোটা হবে৷ বিনিয়োগকারীরা সচেতন হবেন, সতর্ক হবেন৷ মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে সম্মান জানাতে শিখবেন, যেটা তাঁদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না৷
আর ইতিহাস মনে রাখবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷ সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পর, স্পষ্টতই আবেগ আক্রান্ত মমতা বলেছেন, ক্ষমতায় আসার পর এতদিন তিনি এই একটি প্রতিশ্রুতিই রাখতে পারেননি৷ সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া৷ এবার তিনি শান্তিতে মরতে পারবেন! সত্যিই তাই৷ কারণ, উপমহাদেশের গণ আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি অমরত্ব পেয়ে গেছেন৷ মানুষ তাঁকে মনে রাখবে, মাটি তাঁকে মনে রাখবে!