মেলায় মেলায় কত তফাৎ!
১৭ অক্টোবর ২০১৭সম্প্রতি ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র জার্মানির অন্যতম মেলা ‘অক্টোবরফেস্ট' দেখার সুযোগ হয়েছে আমার৷ আর তখনই চোখে পড়লো বাংলাদেশের মেলাগুলোর চেয়ে এদেশের মেলার কিছু পার্থক্য৷
অক্টোবরফেস্ট মূলত বিনোদন মেলা৷ অনেকের কাছে এটি কেবলই ‘বিয়ার পান'এর মেলা৷ তবে আমার কাছে এই মেলাকে তার চেয়েও বেশি কিছু মনে হয়ছে৷ প্রায় ২০ দিন ধরে চলে এই মেলা৷ কখনও কখনও সময় বাড়ানো হলে তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চলে৷ সময় গড়াতে থাকলেও মানুষের আগ্রহে কিন্তু ভাটা পড়ে না৷ এত বড় পরিসরের একটা মেলা অথচ আয়োজনটা প্রায় যেন ত্রুটিহীন৷
বাংলাদেশে এধরনের মেলার মধ্যে বৈশাখী মেলা, পৌষমেলা, জাতীয় লোকজ উৎসব, নবান্ন উৎসব অন্যতম৷ এর বাইরে শহুরে সমাজে আজকাল বসন্ত বরণ, বর্ষা বরণ, পিঠা উৎসব, মধু মেলা হয়ে থাকে৷ শহরের মধ্যে খানিকটা জায়গা বের করে কখনও কখনও জিনিসপত্রের পসরার বাইরে ছোট্ট করে শিশুদের জন্য নানান খেলাধুলার আয়োজনও হয়৷ তবে, এটা ঠিক যে আমাদের বাবা-চাচাদের কাছ থেকে মেলার যে গল্প শুনেছি তা গত ত্রিশ বছরে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি৷ তারপরও আমার সময়ে গ্রাম-শহর দুই জায়গাতেই অবশ্য বেশ কিছু মেলা আমি দেখেছি৷
বাংলাদেশে মাসব্যাপী বইমেলা ছাড়া কোন বিনোদন মেলা লম্বা সময় ধরে হওয়ার রেকর্ড নেই৷ আর তাছাড়া বিশাল এলাকা জুড়েও হয় না৷ শহরে তো বটেই, গ্রামেও না৷ তবে ইউরোপ আর বাংলাদেশে বিনোদনের ধরনগুলো প্রায় একইরকম৷ খাবারের আয়োজন, নানা ধরনের রাইড, মেলার একপাশে যাত্রাপালা বা জাদুর আসর, নানান ধরনের স্যুভেনিরের দোকান... এই তো৷
শুরুতেই যদি খাবারের প্রসঙ্গে আসি তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের মেলাগুলোতে হালকা খাবারের জিনিস বেশি চোখে পড়ে৷ অর্থাৎ কেউ সারাদিন থাকতে চাইলে নি:সন্দেহে তাকে ক্ষুধার কষ্ট করতে হবে৷ তবে একেবারে ঘরে তৈরি নাড়ু, মুড়ি, খৈ, বাতাসা....এসবের সাথে দুনিয়ার আর কোন কিছুর তুলনা চলে না৷ ইউরোপের মেলায় হাজার পদের খাবার হয়ত থাকে, ভোর থেকে রাত অবধি সময় কাটাতে চাইলে এবং একেক বেলায় একেক খাবার খেতে চাইলেই পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতে আমার খুব একটা স্বস্তি মিলবে না৷
অক্টোবরফেস্টে অনেকে কেবল বিয়ার পান করতেই যান৷ সাথে দিনভর চলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা৷ সেই আড্ডা চাইলে মাঝরাত পর্যন্তও চালিয়ে নেয়া যায়৷ বাংলাদেশের কোন মেলাতে এটি সম্ভব নয়৷ কেউ চাইলে শতাধিক রাইড এ চড়তে পারেন না৷ একসাথে সব বয়সিদের জন্য এত রাইড অবশ্য বাংলাদেশে এখনও নেই৷ এখনও নাগরদোলা, স্লিপার, দোলনা এসবেই সীমাবদ্ধ বাংলাদেশের রাইডের আয়োজন৷
এদেশের মেলার আরেকটি বিশেষ দিক হলো, সব বয়সিদের অংশগ্রহণ৷ এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকেও অক্টোবরফেস্ট উপভোগ করতে আসেন দর্শনার্থীরা৷ বাংলাদেশে অবশ্য এখনও এমন আন্তর্জাতিক মানের কোন মেলা হয়নি৷
তবে আমাদের দেশেও এক সময় গ্রামীণ মেলাগুলোতে নাতি নাতনিদের হাত ধরে দাদা-নানারা নিয়ে যেতেন৷ জিলাপি, নিমকি, সন্দেশ কিনে দিতেন৷ সেই অর্থে সব বয়সিদের অংশগ্রহণ ছিলো৷ তবে এখন হয়ত এই সংখ্যা অনেকখানিই কমেছে৷
অক্টোবরফেস্টের আয়োজনের সবখানেই চোখে পড়ে মুন্সিয়ানা৷ অচেনা শহরে হঠাৎ করে যদি কেউ চলে আসেন মেলা দেখতে, কোন সমস্যা নেই ভেন্যু চিনতে৷ শহরের মূল পরিবহন স্টেশন থেকেই সাদা চুনকালিতে ‘অক্টোবরফেস্ট' লিখে তীর চিহ্ন দেয়া৷ ফলে যে কেউই খুঁজে বের করে ফেলতে পারবেন৷
প্রতিবছর এই মেলায় প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ মানুষ অংশ নেন৷ তার মানে হলো, প্রতিদিন গড়ে হাজার হাজার মানুষ৷ এত মানুষের মেলায় নিরাপত্তার কোন বাড়াবাড়ি চোখে পড়লো না৷ কেবল প্রবেশের সময় ব্যাগ তল্লাশি হলো৷ এরপর পুরো সময় একজন পুলিশও মেলার ভেতরে নজরে আসেনি৷ তবে ইদানিং বাংলাদেশের যে-কোনো অনুষ্ঠানে আইন-শৃংখলাবাহিনীর সদস্যদের বাড়াবাড়ি উপস্থিতি অনেকাংশেই অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য্য নষ্ট করে বলেই আমার মনে হয়৷ পহেলা বৈশাখের মতো সার্বজনীন উৎসবে রাজধানীতে বিকেল ৫টার পর কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না বলে আগেই ঘোষণা দেয়া হয়, যা সত্যিই দু:খজনক৷
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো রাজধানী জুড়ে যখন মেয়েরা সাদা-লাল বা রঙ্গিন শাড়ি পরে, খোপায় ফুল গুঁজে হেঁটে যায়, আর ছেলেরা পাঞ্জাবি- পাজামা, সেই দৃশ্য যেমন অসাধারণ, তেমনি জার্মানিতেও অক্টোবরফেস্টে মেয়েরা ড্রিনডেল আর ছেলেরা লেডারহোসে পড়ে ঘুরে বেড়ায় শহর জুড়ে, সেটিও চমৎকার লাগে দেখতে৷
তবে অক্টোবরফেস্ট এক জায়গায় খুব এগিয়ে৷ আর তা হলো, এত মানুষের জন্য টয়লেটের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা৷ ঝকঝকে তকতকে টয়লেটের আশা তো আমার ছিলই না, বিশেষত নিজের দেশের যে অভিজ্ঞতা আমার আছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷