যাদের কাজের ঠিক নেই, ঠিক নেই মজুরি
১ মে ২০১৮বিবিএসের হিসাব দেখলে বাংলাদেশের শ্রমিক ও শ্রমশক্তি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৭ লাখ৷ এ শ্রমশক্তির মধ্যে ৫ কোটি ৮০ লাখ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত৷ বাকি ২৭ লাখ বেকার৷
আর এই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ৷ আর ১ কোটি ৬ লাখ আছেন দিনমজুর, যাঁদের কাজের নিশ্চয়তা নেই, নেই মজুরির কোনো নিশ্চয়তা৷ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র মতে তাঁরাও বেকার৷
বিবিএস-এর আরেক হিসাব বলছে, বাংলাদেশে এখন ২৫ লাখ গৃহকর্মী বা গৃহশ্রমিক আছেন৷ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে এমন শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার, যাদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছর৷ এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই মেয়েশিশু৷
ঢাকার কলাবাগানের গৃহকর্মী হোসনে আরা৷ বয়স ৩০ বছর৷ তিনি অবশ্য স্থায়ীভাবে কোনো বাসায় কাজ করেন না৷ একাধিক বাসায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ‘ছুটা' কা করেন তিনি৷ ডয়চে ভেলেকে হোসনে আরা বলেন, ‘‘প্রতিটি কাজের জন্য পাই ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা৷ তাতে মাসে ৬ হাজার টাকার মতো আয় হয়৷ কিন্তু কাজ করলে মজুরি আছে, কাজ না করলে নাই৷''
অন্যদিকে এক বাসায় যাঁরা স্থায়ীভাবে কাজ করেন, তাঁদের থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও বেতন দেয়া হয় সামান্যই৷
বাংলাদেশে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও তাঁদের বেতন কাঠামো, নিয়োগ এবং কর্মঘণ্টা নিয়ে কোনো আইন হয়নি৷ গৃহকর্মীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনে যুক্ত কাজী সিদ্দিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের অধীনে আনার দাবি জানাচ্ছি দীর্ঘদিন ধরে৷ আমরা গৃহকর্মীদের নিয়েগপত্র, বেতনকাঠামো এবং কর্মঘণ্টার দাবি জানিয়ে আসছি৷ সরকার একটা কমিটিও করেছে৷ কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি৷ আরেকটা সমস্যা হচ্ছে গৃহকর্মীদের নানা ক্যাটাগরি আছে৷ সেই ক্যাটাগরি নির্ধারণ দরকার৷''
বাংলাদেশে দিনমজুরদের মধ্যে কৃষি শ্রমিক যেমন আছেন, তেমনি নির্মাণ, শিল্প, পরিবহন, উন্নয়নসহ নানা খাতে দিনমজুর শ্রমিক কাজ করেন৷ তাঁদের প্রতিদিনের কাজের জন্য সকালে অপেক্ষা করতে হয়৷ গ্রামাঞ্চলে যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁরা কাজ পান৷ তবে শহরাঞ্চলে দালালের ওপর নির্ভর করতে হয়৷ ঢাকায় এখনো দিনমজুর শ্রমিকের হাট আছে৷ প্রতি সকালে এই হাট বসে৷ যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী এই হাট থেকে শ্রমিক নিয়ে যান৷ এখানে মজুরির ঠিক নেই, ঠিক নেই কর্মঘণ্টা৷
সেরকমই একজন শ্রমিক আমান উল্লাহ৷ থাকেন ঢাকার মান্ডা এলাকায়৷ স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাটিকাটা, পাইপ লাগানো থেকে শুরু করে আরো অনেক কাজ করি আমি৷ কোনোদিন কাজ পাই আবার কোনোদিন পাই না৷ সাধারণত দিনে ৫শ' টাকা মজুরি ও খোরাকি দেয়৷ এর কম-বেশিও হয়৷ নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর৷ আর কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট নয়৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমাদের মজুরি সরকার নির্দিষ্ট করে দিলে ভালো হয়৷ কিন্তু এটা আমরা কার কাছে বলবো? আর আমরা বললেই কি সরকার তা করবে!''
কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিকদের বড় একটি অংশই দিন মজুর৷ আবার যাঁরা মাস বা বছর চুক্তিতে কাজ করেন, তাঁদেরও মৌখিক চুক্তিতেই কাজ করতে হয়৷ ফলে চুক্তি লঙ্ঘন করলে তাঁরা কোনো প্রতিকার পান না৷ বাংলাদেশে পরিবহন খাত অনেক শক্তিশালী হলেও চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের বড় একটি অংশ মজুরি পান দিন অথবা ট্রিপ ভিত্তিতে৷ আর প্রাইভেট কার চালকরা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করলেও বেতন ১০ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকার মধ্যে৷ কিন্তু তাঁদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট নয়৷ এসব খাতে কিছু অলিখিত নিয়ম থাকলেও তা শ্রমিকবান্ধব নয়৷
আর নারীদের ঘরের কাজের তো কোনো অর্থনৈতিক মূল্যায়নই নেই৷ অ্যাকশন এইডের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৪ সালে নারীরা ঘরের যে কাজ করেছেন তা ওই বছরের জিডিপির ৭৮ থেকে ৮৭ ভাগ৷ ওই সময়ের হিসেবে গ্রহণযোগ্য মূল্য পদ্ধতিতে তার মূ্ল্য হতো ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা৷
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর অর্থনীতিবিদ ড, নাজনীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের শ্রম শক্তির বিশাল একটি অংশ ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করেন৷ ফলে তাঁরা জাতীয় মজুরি নীতির মধ্যে নেই৷ এ কারণে সেখানে শ্রম শোষণের ঘটনা ঘটে৷ তাঁদের ক্ষেত্রে কর্মঘণ্টা মানা হয় না৷ শ্রম আইনের কোনো সুবিধা পান না তাঁরা৷ তবে এটা শ্রম আইনের অধীনে আনাও অনেক কঠিন, কারণ, মনিটর করার জন্য যথেষ্ট জনশক্তি নেই৷''
তবে তিনি বলেন, ‘‘এখন সম্ভব না হলেও কমপক্ষে একটি নীতিমালা থাকা দরকার, যা সবাই অনুসরণ করবেন৷ আর আমি মনে করি, বাংলাদেশ যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে, তাই দেশের উন্নয়নের প্রয়োজনেই তাঁদের শ্রম আইনের অধীনে আনতে হবে৷''