যেখানে রাজনীতিই নেই, সেখানে সমস্যা রাজনৈতিক হবে কেন?
২০ আগস্ট ২০১৮ডয়চে ভেলে: দেশে কিছুদিন ধরে হঠাৎ হঠাৎ বিক্ষোভ বড় আকার ধারণ করছে, এর কারণ কী?
আফসান চৌধুরী: বিক্ষোভ বিক্ষোভই৷ এটা ছোট-বড় হয় না৷ ক্ষোভ থেকেই তো বিক্ষোভ৷ আমাদের দেশে এখন একটা সংকটাপন্ন অবস্থা নিশ্চয়ই চলছে৷ এর মধ্যে ক্ষোভটা এভাবেই প্রকাশ হয়৷ আমাদের সমস্যাগুলো হলো কাঠামোগত সমস্যা৷ এটা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে৷ আমার মতে, জনপ্রশাসনিক ব্যর্থতার বিষয়টি বারবার আসে৷ এসব কারণে আমাদের কাছে মনে হয়, ছোট বিক্ষোভ বড় হচ্ছে৷ তবে এসব বিক্ষোভের অধিকাংশই কিন্তু নগরকেন্দ্রিক৷ এটা স্মরণে রাখলেই বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে৷
সরকারের উপর কি মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে?
বিষয়টা রাজনৈতিকভাবাপন্ন মানুষ এটাকে সরকারের উপর নিয়ে যাচ্ছে৷ আমরা যে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোটা দাঁড় করিয়েছি, সেটার সঙ্গে সরকারের কোনো বিষয় নেই৷
এই সরকার না, যে সরকারই ক্ষমতায় থাক, তারা এটা থেকে বের হতে পারবে না৷ এই সমস্যার সমাধান করা প্রায় অসম্ভব৷ এটা সারতে হলে দীর্ঘদিন লাগবে৷ এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে তাদের উপর দোষ দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে৷ এটা আমাদের রাজনীতিভাবাপন্ন মানুষের সীমাবদ্ধতা৷ আমাদের পরিবহন সমস্যা আর চাকরির সমস্যা এটা কোনো সরকার সমাধান করেনি৷ মধ্যবিত্তের চাকরির যে সমস্যা, তারা নিজেরাই সমাধান করার চেষ্টা করেছে৷ তারা বিদেশে গিয়ে কাজ করছে৷ এটা এখন শহরে প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ এই আন্দোলনটাও মধ্যবিত্ত শ্রেণির৷ গ্রামের মানুষ ভালো আছে৷ উচ্চবিত্তরাও আরো বেশি টাকার মালিক হচ্ছে৷ মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংকটে পড়ে আছে৷ এর সঙ্গে সরকারের কোনো কিছু নেই৷ থাকলে এটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আছে, প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে সমস্যা আছে৷
এক ধরনের পরাধীনতা কি এর সঙ্গে জড়িত বলে আপনার মনে হয়?
আমি ৪৫ বছরের বেশি সাংবাদিকতা করি৷ কোনোদিন মনে হয়নি আমরা স্বাধীন৷ আসলে আমরা যে ব্যবস্থাটা করছি, সেটা অ্যাডহক৷ আমার মনে আছে, স্বাধীনতার দুই-তিন বছর পর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ যখন বাজেটে গ্যাসের দাম বাড়ালেন, তখন অনেক মানুষ প্রতিবাদ করেছিলেন৷ এখন খবর হচ্ছে, আমাদের যে গ্যাস আছে সেটা দিয়ে চলবে আর ৮/৯ বছর৷ আমরা কোনোদিন ভাবিইনি আমাদের গ্যাস শেষ হতে পারে৷ তাহলে বিকল্প জ্বালানি কী হতে পারে তা আমরা কোনোদিন ভাবিনি৷ যদি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হতো তাহলে এর একটা ব্যবস্থা হতো৷ এবার যে আন্দোলনটা হলো, সেটার মধ্যে আমরা রাজনীতি দেখি৷ আসলে আমাদের যদি কোনো পরাধীনতা থাকে, তাহলে সেটা হলো ভাবনার পরাধীনতা৷ সমস্যা সাধানের প্রচেষ্টা আমাদের মধ্যে খুবই সীমাবদ্ধ৷
আগেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।৷কিন্তু এভাবে বিক্ষোভ হয়নি৷ বিক্ষোভ এখন কেন এত বড় আকার ধারণ করল?
কিছুদিন আগে যে ছেলেগুলো ধরা পড়ল, তারা তো নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করতে যায়নি৷ তার আগে যেসব ছাত্র রাস্তায় এসেছিল, তারা নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করছিল৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, সরকার তো সড়কের সমস্যার সামাধান করছে না৷ সরকার বলতে আমি রাজনৈতিক সরকার বোঝাচ্ছি না, প্রশাসনিক সরকারের কথা বলছি৷
আমি অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি, এই সমস্যার সমাধান এই সরকার না, কোনো সরকারই এসে এর সমাধান করতে পারবে না৷ যে অর্থনৈতিক মডেলের উপর দেশ চলছে, সেখানে আইন করে এর সমাধান করা যাবে না৷ আমার মনে আছে, ২০১৫ সালেই আইন হয়ে আছে৷ আসলে আইন দিয়ে কী হবে যেখানে আইনের শাসন এত দুর্বল? সামনে যে আন্দোলন হবে, সেটাও বড় হবে৷ মানুষ মনে করে, আন্দোলন করে আমি সব পেয়ে যাব৷ আসলে কী পাবে তা সে জানে না৷ ছাত্ররা যে ৯ দফা দিয়েছে, সেটা করতে হলে ২০ বছর দরকার৷ আসলে সমাধানের জন্য ইচ্ছে, দক্ষতা দরকার৷ আমার মনে হয় না সেই ইচ্ছে কারো আছে৷
সরকার তো অনেক কাজ হাতে নিয়েছে, এক ধরনের মনযোগ তো তাদের আছে...
এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন৷ অবকাঠামোতে সরকারের মনযোগ বেশি৷ চীন ও ভারত তো অবকাঠামোতে বেশি টাকা দিচ্ছে৷ এটা তো কণ্ট্রাকটারি ব্যবসা৷ দরকার হলো গণপরিবহনে নজর দেয়া৷ এটা করতে হলে গোটা দেশের উন্নয়ন দরকার৷ ট্রান্সপোর্ট সেক্টরে বিনিয়োগ কাদের, যাদের কালো টাকা আছে৷ এখানে কাজ করতে হলে বিআরটিএ'র রুজিতে আঘাত পড়বে৷ অনেকের স্বার্থে লাগবে৷ তাহলে সারাদেশের একটা সংস্কারে হাত দিতে হবে৷ সব বাসের ফিটনেস থাকতে হলে তাদের কী পরিমান বিনিয়োগ বাড়াতে হবে৷ এখন সব নিয়মমতো চললে তাদের আয়ে কতটা হাত পড়বে? শ্রমিকদের দক্ষ করার জন্য আমরা তো ব্যবস্থা নিচ্ছি না৷ দক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ করতে আপনার যত টাকা দিতে হতো, তার চেয়ে কম টাকা দিয়ে আপনি অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে সস্তায় লাভ করে নিচ্ছেন৷ এই কারণে এখানে বারবার বিক্ষোভ হবে, কখনো ছোট, কখনো বড়৷
আসলে শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে কী লাভ৷ তারা কী পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করে সেটা আমি দেখেছি৷ ওরা মদ খায়, নেশা করে, এমন অনেক অভিযোগ দেয়া হবে৷ আসলে এটা গোটা খাতেরই সমস্যা৷ সবাই বলছে, মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই৷ কী হবে মন্ত্রী পদত্যাগ করলে? সবাই বলছে, চালকের ফাঁসি চাই৷ কী হবে এমন পাঁচজন চালকের ফাঁসি হলে? আসলে যতক্ষণ না মানুষ মরছে, ততক্ষণ আমরা এটা কোনো সমস্যাই মনে করি না৷
বিক্ষোভ নিয়ে আমরা সব সময়ই ষড়যন্ত্রের কথা শুনি, এ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...
যতদিন রাজনীতি আছে, ততদিন বিক্ষোভ নিয়ে যড়যন্ত্রের আলোচনা হবে৷ আমাদের দেশে রাজনীতির যে অবস্থা আর পরিবহন খাতে এই কাঠামো একই রকম৷ দুটোই অপ্রতিষ্ঠিত, দুটোই ইনফরমাল৷ এবার বেশি এসেছে সামাজিক যোগাযাগের মাধ্যমের কারণে৷ আসলে স্বচ্ছভাবে তথ্যের অভাবেই গুজব ডালপালা মেলে৷ আমি একটা লেখা লিখেছি, ছাত্ররা রাস্তায় নেমে যখন লাইসেন্স চেক করা শুরু করল, সেটা কিন্তু আইনের বরখেলাপ৷ আমরা সবাই খুশি হলাম৷ দেখলাম, পুলিশ লাইসেন্স ছাড়া চলে৷ কিন্তু আপনি যদি আইনের কথা বলেন, তাহলে ওরা যতই দেখিয়ে দিক, তারপরও এটা বেআইনি৷ এরপর পুলিশের সঙ্গে হেলমেটবাহিনী নামলো, সেটাও বেআইনি৷ দুই পক্ষই কিন্তু আমরা বেআইনি কাজগুলো করছি৷ তারপর আমরা ধমক দিয়ে বলছি, এটা করা যাবে না৷
আজকেই আমার এক ছাত্র এসে আমাকে বলল, স্যার, রাস্তায় পুলিশ আমাকে থাপ্পর দিয়েছে৷ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কী করলে? সে বলল, প্রতিবাদে আমরা আজ কেউ পরীক্ষা দেইনি৷ পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আসলে একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক৷ বিষয়টাকে আমরা রাজনৈতিক করে ফেলি৷ আসলে দেশে রাজনীতিই নেই, সেখানে কোনো সমস্যা রাজনৈতিক হতে যাবে কেন? আসলে কোটা আন্দোলন বলা হচ্ছে সরকারবিরোধী আন্দোলন৷ আসলে আমি দেখি, এটা সরকারে যাওয়ার আন্দোলন৷ তারা সবাই সরকারের অংশ হতে চায়৷ আসলে কোনো কিছুই রাজনৈতিক নয়৷