যৌন নির্যাতনের শিকার যখন শিশু
১৯ জুলাই ২০১৭সাংবাদিকদের সবসময় বলা হয়ে থাকে পরিসংখ্যান যতটা পারা যায় এড়িয়ে চলার জন্য৷ গণিত ও সংখ্যায় হাবুডুবু না খেয়ে পাঠকরা যাতে মূল বক্তব্য বুঝতে পারেন, সেটাই এই বলার উদ্দেশ্য৷
কিন্তু তারপরও এই লেখাটা একটা পরিসংখ্যান দিয়েই শুরু করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি৷ ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসের কথা বলছি৷ ধর্ষণ ২৪৪, গণধর্ষণ ৪২, শারীরিকভাবে অক্ষমকে ধর্ষণ ২০, ধর্ষণচেষ্টা ২২, ইভ টিজিং ২১, যৌন নির্যাতন ৩৯, ধর্ষণের পর হত্যা ৩, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা ৩৷ এই সময়ে ধর্ষণ মামলার রায় হয়েছে ১৪টি৷
হ্যাঁ, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের এই পরিসংখ্যানটি শিশুদের নিয়েই৷ ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৪৪৬ জন শিশু৷ এমন অনেক ঘটনাই প্রকাশিত হয় না৷ কিন্তু তারপরও এ বছর এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনা করে নেয়াই যায়৷
হঠাৎ করেই এই আলোচনা পত্রিকার পাতায় ছোট্ট একটি সংবাদকে কেন্দ্র করে৷ ‘মেয়েকে ধর্ষণ করলেন সৎ-বাবা'৷ সেই সৎ বাবাটি আবার চাকরিচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন একটি স্বনামধন্য গণমাধ্যমে৷
গণমাধ্যমকর্মীরা অর্থ-বিত্তের দিক দিয়ে না হলেও চিন্তাভাবনায় অনেকের চেয়ে এগিয়ে আছেন বলে অনেকে ধরে নেন৷ কিন্তু এই অপরাধে যে কেউই পিছিয়ে নেই সে প্রমাণ আমরা আগেও পেয়েছি৷ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, পুলিশ সদস্য এমনকি ধর্মীয় নেতারাও নানা সময়ে দেখিয়েছেন, কারও হাত থেকেই নিরাপদ নয় শিশুরা৷ ফলে কারও সামাজিক অবস্থানের কারণে এই পরিসংখ্যানে খুব একটা হেরফের না হওয়ারই কথা৷
একটা সময় ছিল, যখন নারী শব্দটি উচ্চারণ করার সময় এমনিতেই মুখে চলে আসতো ‘অবলা' শব্দটি৷ নারীর শারীরিক গঠনকে দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করে তার বল বা শক্তি কম ধরে নিয়েই তাই ‘অবলা নারী' শব্দগুচ্ছকে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে বারবার৷
‘অবলা নারী' যে এ জন্য খুব সুবিধা পেয়েছেন তা কিন্তু না৷ এমন না যে, নারীকে অবলা বলায় তাদের পৃথিবীর সব কঠিন কাজ থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন৷ বরং সন্তান লালন-পালন, ঘরের কাজ সামলানোর বাইরেও পুরুষদের সমান তালে কাজ করে যেতে হয়৷ উলটো এই ‘অবলা' ধারণাটিকে বারবারই কাজে লাগিয়েছেন সমাজের পুরুষরা৷ নারী নির্যাতনও বেড়েছে এই ধারণার সমান তালে৷
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, একসময় নারীরাই ছিলেন পরিবার, গোত্র এবং সমাজের ক্ষমতাশালী অংশ৷ সে অবস্থার পরিবর্তন হলো কীভাবে? অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, নারীর জীবনের একটা বড় অংশ যেহেতু গর্ভধারণ এবং সন্তানলালন পালনেই ব্যয় হয়, সেই অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েই ঘটেছে এই ‘অভ্যুত্থান'৷
তবে অবলা শব্দটির সঠিক ব্যবহার বোধ করি শিশুদের ক্ষেত্রেই করা যায়৷ জন্মের পর থেকে শিশু তার প্রতিটা কাজের জন্য নির্ভর করে কোনো না কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর৷ শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়ে এই নির্ভরতা কমতে থাকলেও, এর প্রয়োজনীয়তা কখনই একেবারে ফুরোয় না৷
ফলে সব কিছুতেই বড়দের বিশ্বাস করার প্রবণতা শিশুদের মধ্যেই থাকে৷ বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোর কারণে অনেকক্ষেত্রে বাবা-মায়ের বাইরেও অন্যদের ওপরও নির্ভর করতে হয় শিশুকে৷ আর এই সুযোগটাই কাজে লাগান সুযোগসন্ধানীরা৷
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ প্রতিবাদী ফাউন্ডেশন ও সুইডেন এবং ডেনমার্কের ‘সেভ দ্য চিল্ডরেন' একটি যৌথ সমীক্ষা চালায়৷ সেই সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ৫০ শতাংশ শিশু, অর্থাৎ প্রতি দু'জনের একজন কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার৷ তবে সবচেয়ে মন খারাপ করা বিষয় হলো, এর ৯১ শতাংশ যৌন নির্যাতন পরিবারের আত্মীয়দের দ্বারা সংগঠিত হওয়ার তথ্য দেয়া হয়েছে সমীক্ষায়৷
নানা সময়ে নিজের যৌন লালসা পূরণ করার জন্য ধর্ষকামীরা বেছে নিচ্ছেন সবচেয়ে সহজ শিকার শিশুদের৷ বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার কারণে এই বিষয়ে একটা ট্যাবু তৈরি হয়েই আছে৷ ফলে পরিবারের কারও কাছ থেকে নির্যাতনের শিকার হলে, পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে সেটা শেয়ার করা শিশুদের পক্ষেও সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না৷
প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা যায় দিনের পর দিন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসলেও, কোনোক্ষেত্রে ‘পরিবারের সম্ভ্রম', কখনও ‘ভবিষ্যত হয়রানির' কথা চিন্তা করে অনেকদিন পর্যন্ত বিষয়গুলো ধাপাচাপা দিয়ে রাখা হয়৷
অথচ, হওয়ার কথা ছিল ঠিক উলটোটা৷ মুখ লুকিয়ে থাকার কথা ধর্ষক ও নির্যাতনকারীদের৷ সামাজিকভাবে হেয় এবং আইনের দৃষ্টিতে সাজা হওয়ার কথা ধর্ষকদের৷ সুতরাং এই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এই ট্যাবুটা ভাঙতে না পারলে এই সমস্যা বাড়বে বই কমবে না৷
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেও' এজন্য দায়ী করেন কেউ কেউ৷ নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা, পুলিশের তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়াকেও অনেকক্ষেত্রে অনেক ভিকটিম ‘দ্বিতীয় ধর্ষণ' বলে উল্লেখ করেছেন৷ নির্যাতন এবং মামলার হারের তুলনায় রায় ও শাস্তি কার্যকরের হার খুবই কম৷
অসংখ্য ঘটনার মধ্যে আমরা যদি চাঞ্চল্যকর দু'টি ঘটনার উদাহরণ দেই, তাহলে বিচারব্যবস্থার চিত্রটা মোটামুটি উঠে আসবে বলে আশা করছি৷ দিনাজপুরের পার্বতীপুরে গতবছর পাঁচ বছরের শিশু পূজা ধর্ষিত হয়৷ এ ঘটনায় এক আসামি গ্রেপ্তার করলেও তদন্তের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ৷ কুমিল্লার তনু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তো চাপাই পড়ে গেল অন্য সব নতুন ইস্যুর তলায়৷
তবে গণমাধ্যমের বোধ করি এই সব ক্ষেত্রে দায় আরও বেশি৷ পত্রিকার এক কোণে বা টেলিভিশনের ৩০ সেকেন্ডে না রেখে, যদি ব্যাপক আকারে জনমত গড়ে তোলা যায়, তাহলে তার প্রভাব সবক্ষেত্রেই পড়তে বাধ্য৷ মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে অ্যাসিড সন্ত্রাস এবং ইভ টিজিং কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যম৷
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সেই ঐতিহাসিক বিতর্ক তো আছেই৷ একজন সাংবাদিক ঘটনার সাথে থাকবে, সেটা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তুলে ধরবে, নাকি ঘটনাকে প্রভাবিতও করবে?
আমার অবস্থান মাঝামাঝি৷ একটি সংবাদ বস্তুনিষ্ঠ উপায়ে তুলে ধরা যেমন একজন সাংবাদিকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, পাশাপাশি সমাজে এর কী প্রভাব পড়ছে, সে চিন্তা থেকেও একজন সাংবাদিক নিজেকে দূরে রাখতে পারেন না৷ ফলে রাজনীতি, গণতন্ত্র, অর্থনীতির মতো কাঙ্খিত সমাজ গড়ের তোলার ভূমিকা সাংবাদিক হিসেবে তিনিও অস্বীকার করতে পারেন না৷
শিশুর যৌন নির্যাতন রোধে আপনি কি ভূমিকা রাখতে পারেন? মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে৷