রাজনীতি-গণতন্ত্রে কাঙ্খিত লক্ষ্য বহুদূর!
১৫ ডিসেম্বর ২০২১কেউ কেউ তো বলছেন, আমরা উল্টোপথে চলছি৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আমরা বহুদূর সরে গেছি৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এখানে গণতন্ত্রের ধারণাই হারিয়ে গেছে৷ অর্থনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে সত্যি৷ কিন্তু এখন যারা নির্বাচিত হচ্ছেন তারা তো রাজনীতিকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছেন, কাজ করছেন অর্থ উপার্জনের মানসিকতা নিয়ে ৷ কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে৷ ১৯৮০ এর দশক থেকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি গণতন্ত্রকে নির্বাচনতন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে৷ এটাকে কী গণতন্ত্র বলা যায়? গণতন্ত্র একটা আদর্শ, যা একটু একটু করে বিকশিত হবে৷ আমাদের গণতন্ত্রের ধারণা সীমাবদ্ধ হয়েছে নিতান্ত নির্বাচনের মধ্যে৷ আর নির্বাচন যেটা হচ্ছে, সেটা গ্রহণযোগ্য না৷ আমরা ধারণা করেছিলাম, আস্তে আস্তে আমরা গণতন্ত্রের দিকে যাব৷ কিন্তু গণতন্ত্র এখান থেকে হারিয়ে গেছে৷ অনেকে সমাজতন্ত্রের চিন্তা করতেন, সেটাও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার পর হারিয়ে গেছে৷ তবে আমরা আশা করি, অবস্থা এমন থাকবে না, পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷ এখন একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা৷ যে মানুষ বঞ্চনার শিকার সে এক সময় অবশ্যই প্রতিবাদে এগিয়ে আসবে৷’’
এই ৫০ বছরে রাজনীতি আর গণতন্ত্র কতটা মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়েছে? জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে এবং তার মাধ্যমে যে অর্জন করেছিলাম তার প্রায় সবটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে৷ মুক্তিযুদ্ধের উল্টো পথে দেশ চলছে৷ আমাদের লক্ষ্য ছিল, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা৷ জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা বুঝতাম সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীন অবস্থান৷ এখন আমরা আমেরিকাসহ আধিপত্যবাদী রাজনীতির কাছে নতজানু৷ সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য থেকে আমরা অনেকদূর৷ এখন লুটপাটতন্ত্র চালু হয়েছে৷ মানুষের মধ্যে বৈষম্য বহুগুণ বেড়ে গেছে৷ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিত্ত সংগ্রহের একটা পথ তৈরি হয়েছে৷ মুষ্টিমেয় লোক রাতারাতি অবাধ সম্পদের মালিক হওয়ার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে দখল করে রেখেছে৷ তাদের দুইটা গ্রুপ একটা আওয়ামী লীগ আরেকটা বিএনপি৷ তাদের ভেতরে দ্বন্দ্ব হল লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে৷ এখন ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৪১ কিন্তু ভিশন ১৯৭১টা কোথায় গেল? এ প্রশ্নের তো তারা উত্তর দেয় না৷ গণতন্ত্র তো বটেই, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করা হয়েছে৷ ভোটাধিকারকে ধ্বংস করা হয়েছে৷ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে গাট্টিবোচকা নিয়ে বিদেশে চলে যেতে হবে এটা তো ক্ষমতাসীন দলের সেক্রেটারি নিজেই বলেছেন৷ বিএনপিও একই পলিসি চালিয়েছে৷ তারাও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছে৷ এগুলোর সঙ্গে তো মুক্তিযুদ্ধের কোন সম্পর্ক নেই, বরং বিপরীতমুখি অবস্থান৷’’
পরিস্থিতি এতটা খারাপ বলে মনে করেন না আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন৷ প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ৫০ বছরে দেশটার মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে৷ এই পরিবর্তনটা হল, দারিদ্রসীমার নিচে বাস করত ৬৫ ভাগের বেশি মানুষ, সেই দেশটাতে এখন সকলের জন্য অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা হয়েছে৷ আমার কাছে গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট না৷ গণতন্ত্র মানে মানুষের বাঁচার অধিকার, মানবাধিকার৷ কেউ না খেয়ে থাকবে না, এটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন৷ সুতারাং ৫০ বছরে এই কাজটা হয়েছে৷ এখন আমরা খাদ্যে আত্মনির্ভরশীল৷ ফলে এটাকে আমি গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবেই মনে করি৷ দ্বিতীয়ত হচ্ছে, তবে এই ৫০ বছরে গণতন্ত্রের যে ইনস্টিটিউশন সেগুলো সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি৷ এর জন্য দায়ি ৭৫ পরবর্তী মিলিটারি সরকার৷ তারা সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে৷ ফলে আমাদের গণতন্ত্র এখন হাঁটি হাঁটি পা পা বা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে৷ গণতন্ত্রের ব্যাপারে আমাদের লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি৷’’
আওয়ামী লীগ তো টানা প্রায় ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায়৷ তাহলে কেন এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে? জানতে চাইলে জনাব লেননি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার দৃষ্টান্ত কী আপনি আরেকটা দেখাতে পারবেন? অনেক দেশেই খুন হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশের মতো কোন উদাহরণ নেই৷ জিয়ার পথ অবলম্বন করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে নিল৷ ফলে এখন গণতন্ত্র প্রথম থেকেই হোঁচট খাচ্ছে৷ এই কারণে এখনও শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি৷ শাসক দলের একজন কর্মী হিসেবেও আমি এ কথা স্বীকার করি৷’’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের যে মূল আকাঙ্খা গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্য, বলতে আমাদের কষ্ট হয় ৫০ বছর পর যখন মূল্যায়ন করি তখন দেখি এগুলো বাংলাদেশে নেই৷ মানুষের ভোটের অধিকার নেই৷ কথা বলার অধিকার নেই৷ সংবাদপত্রের প্রকৃত স্বাধীনতা নেই৷ দেশে এখন লুটেরা অর্থনীতি চলছে৷ ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরীব আরও গরীব হচ্ছে৷ নিম্ন মধ্যবিত্ত এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে পৌঁছে গেছে৷ সবদিক দিয়ে যদি বিবেচনা করি, এই ৫০ বছরে যে অর্জন আমাদের প্রত্যাশিত ছিল সেটা তো হয়ইনি, বরং গণতান্ত্রিক যে ব্যবস্থা আসার কথা ছিল তার থেকে বহুদূর চলে গেছি৷ এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে৷ এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত৷ জনগণের কোন মৌলিক অধিকার নেই৷ মুক্তিযোদ্ধাদের যে স্বপ্ন ছিল সেটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি৷ ৫০ বছরের পূর্তিতে এসে আমেরিকা আমাদের দেশের একটা সংস্থাকে, কিছু কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা দেয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য৷ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আমাদের জন্য লজ্জার৷ গণতন্ত্রকে হত্যা করার কারণেই এখানে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে৷ গর্ব করার মতো আমাদের তেমন কিছু অর্জিত হয়নি৷ অর্থনীতির কিছুটা অর্জন আছে, তাও সেটা লুটেরা অর্থনীতি৷ এখানে সাধারণ মানুষের জীবন মানের কোন উন্নতি হয়নি৷’’
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ৫০ বছর পরও কেন একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিস সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘৫০ বছর একটা দেশের জন্য বড় সময় নয়৷ যেহেতু স্বাধীনতার পর থেকে ৫০ বছর ফলে এই সময়টা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ যে কোন স্থাপনার ভিত্তি মজবুত না হলে স্থাপনা যেমন দূর্বল হয়ে যায়৷ বঙ্গবন্ধু যেভাবে ভিত্তি রচনা করতে চেয়েছিলেন সেভাবে তিনি পারেননি৷ সংবিধান দিয়ে গেছেন, দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন৷ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে তার আদর্শ, দর্শন সবকিছুকে হত্যা করা হয়েছে৷ ফলে এই ৫০ বছরে যে ভিত্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি৷ এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা দুর্বল ভিত্তিটাকে শক্ত করে সামনের দিকে এগুনোর চেষ্টা করছেন৷ সেই জায়গায় এখন আমরা আছি৷ এই দেশের একটা দূর্ভাগ্য হল, যারা স্বাধীনতা চায়নি তারাও এই দেশটা শাসনের সুযোগ পেয়েছে৷ এই ধরনের নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝে দেশটা এগিয়ে চলছে৷ মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন ছিল, সেই জায়গায় আমরা পৌঁছতে পারিনি৷ সর্বক্ষেত্রেই আমাদের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল, এখনও আছে৷ এটা নিয়েই আমরা এগিয়ে চলেছি৷’’