রানা প্লাজায় আহতদের জীবনযুদ্ধ
১৪ এপ্রিল ২০১৮মেশিনের নীচে আটকা পরে মৃত্যুর অপেক্ষায় চারদিন শুয়েছিল রুবিনা বেগম৷ কিন্তু সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর ১ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হলেও বেঁচে ফিরেছিলেন তিনি৷ এখন অবশ্য প্রায় সকালেই ঐ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেই ভালো হতো বলে মনে করেন তিনি৷
অথচ মেশিনের নীচে চাপা পরে চারদিন আটকে থেকে মৃত্যুর গন্ধ নিতে নিতেই তিনি আরেকবার বাঁচার আশা করছিলেন, মমতাময়ী মায়ের মুখটি অন্তত একবার দেখার জন্য৷
কিন্তু পাঁচ বছর পেরোনোর পর যখন সংসার টানতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে তখন রুবিনার প্রায়ই মনে হয় কীভাবে আর কেনই বা তিনি শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহতম ঐ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরলেন!
৩৫ বছর বয়সি রুবিনার কাছে গেলে তিনি জানালেন তাঁর করুণ কাহিনি৷ বললেন, ‘‘উপার্জন করে ন'বছর ধরে আমিই আমার পরিবারে সহযোগিতা করেছি৷ কিন্তু এখন আমার হাতে নিয়মিত কাজ নেই৷ রানা প্লাজার ঘটনার পর যা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম তার প্রায় বেশিরভাগই আমার চিকিৎসার পেছনে ব্যয় হয়েছে৷ দুর্ঘটনার পর আগের মতো কাজ করতে পারি না৷ তাই আর আয় নেই বললেই চলে৷ মাঝে মাঝে মনে হয় কেন বেঁচে গেলাম!''
রানা প্লাজার সাত তলায় থাকা একটি গার্মেন্ট এর পকেট সেলাইয়ের কাজ করতেন রুবিনা৷ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল যখন ভবনটি ধসে পরে তখন সেখান থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার পাওয়া প্রায় দু'হাজার শ্রমিকের মধ্যে তিনি একজন৷
রানা প্লাজার ওই ঘটনার পর থেকেই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলো একসাথে ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মস্থল, চার হাজারেরও বেশি কারখানার নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাপ তৈরি করে৷
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বাজার ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার৷ অথচ এ শিল্পটির শ্রমিকরা বড় বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েও অরক্ষিতই রয়ে গেল৷
শ্রম-অধিকার কর্মীরা বলছেন, রানা প্লাজা ধসের পর সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া অনেক শ্রমিকই অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরেন৷ আবার অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরায় কাজে ফিরে যেতে পারেননি শেষ পর্যন্ত৷ এদের কেউ কেউ কাজের ব্যাপারে পুরোপুরি তৈরিও হতে পারেননি আজ পর্যন্ত৷
ন্যাশনাল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন এর সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘‘আহত শ্রমিকরা মানসিক ও শারিরীক সংকট নিয়েই বেঁচে আছে৷ বেশিরভাগই শারীরিক ক্ষত নিয়েই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছেন৷ কেননা তাঁদের জন্য পুরো সময় কাজ করা কঠিন৷ তাঁরা যে অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছিল, তা অতিদ্রুত শেষ হয়ে গেছে৷''
যেখানে রানা প্লাজা ধসেছিল সেই জায়গায় এখন ঘাস জন্মেছে৷ রয়েছে আবর্জনার স্তূপ৷ প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল সেখানেই ফুল দিয়ে নিহতদের স্মরণ করা হয়৷
সেখানে থাকা ধুলায় ধুসরিত হয়ে যাওয়া এপিটাফে লেখা – ‘অশ্রুসিক্ত নয়নে আমরা তোমাদের স্মরণ করছি এবং আমরা কখনো ভুলবো না৷'
‘‘কিন্তু আমরা ভুলে গেছি'', বললেন রানা প্লাজার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া লুৎফা বেগম৷
তিনি বলেন, ‘‘গত কয়েকবছর ধরে কেউ আমাদের খোঁজও নেননি৷ আমি যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম তা মেয়ের বিয়ে, দু'টি গরু কিনে এবং চিকিৎসার পেছনে অনেক আগেই খরচ হয়ে গেছে৷এখন আমি মিষ্টি বানাই আর বিক্রি করি৷''
৪০ বছর বয়সি লুৎফা বেগম রানা প্লাজার আট তলায় পায়জামা সেলানোর কাজ করতেন৷ তিনি স্পষ্ট মনে করতে পারেন দুর্ঘটনার সময়টি৷
তিনি বলেন, ‘‘আগের দিন ভবনে বড় ফাটল থাকায় আমাদের ভবনটি খালি করতে বলা হয়েছিল৷ ভবন ধসের দিন আমরা শক্তভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম মাত্র৷ কারণ আমরা জানতাম আমাদের সামনে কোনো ভবিষ্যত নেই৷''
‘‘আমার স্বপ্ন ছিল আমি গ্রামে গিয়ে একটি দোকান খুলবো৷ শেষ কয়েক বছরে সেই বিশ্বাস ক্রমাগত ভেঙে গিয়েছে৷''
রানা প্লাজার আহতরা দুঃসহ সেই স্মৃতি নিয়েই জীবনযুদ্ধে ফের নেমেছেন৷ নতুন জীবন যেন তাদের পুরনো জীবনের চেয়ে আরও কঠিন, স্বপ্নহীন!
এইচআই/ডিজি
পাঠক, প্রতিবেদনটি আপনাদের কেমন লাগল তা নীচের ঘরে জানান৷