লকডাউনে ঘরে বসেই গান শোনাচ্ছেন শিল্পীরা
১৯ এপ্রিল ২০২০করোনার প্রকোপে স্তব্ধ হয়ে আছে ভারতের বিনোদন জগত৷ সিনেমা, নাটক, খেলা থেকে সংগীত – কোনো পরিসরই মুক্তভাবে তার কাজ চালিয়ে যেতে পারছে না৷ কিন্তু ঘরে বসে বসেই সংগীতশিল্পীরা ফেসবুকের সাহায্যে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁদের শিল্প৷ মঞ্চের সাথে দর্শকাসনের মধ্যে কোনো ফারাক নেই সেখানে৷ ইন্টারনেটের বদৌলতে, শিল্পী-শিল্প-শ্রোতা সবাই লাইভে একাকার৷ কী ভাবে দেখছেন এই সময়টাকে শিল্পীরা?
বাংলা লোকগানের দল ‘দোহার’-এর তরুণ সদস্য সুদীপ্ত চক্রবর্তী গান গাওয়ার পাশাপাশি তালবাদ্যও বাজান৷ একাধিক ফেসবুক পেজের হয়ে গান শুনিয়েছেন তিনি ইতিমধ্যে৷ তিনি বলেন, ‘‘ফেসবুকে গান শোনানোর এই ধারায় গান শোনানো এখন খুব সহজ হয়ে যাচ্ছে৷ বড় বড় শিল্পীরা যে আবেগের জায়গা থেকে লাইভে এসে গান শোনাচ্ছেন, তা শ্রোতারা বুঝতে পারছেন না৷ আমরা জানি যে, করোনার কোপে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হবে৷ স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে গান-বাজনার অনুষ্ঠানের পেছনে খরচও কমবে৷ কে জানে, ভবিষ্যতে হয়তো কেউ সিনিয়র শিল্পীকেও বলে বসবেন কোনো সহযোগী শিল্পী ছাড়া একাই গাইতে আসতে৷ ওই যে, যেমনটা লাইভে শুনেছিলেন! মিউজিকের যে সার্বিকতা শিল্পীরা শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরতে চান, তা নষ্ট হচ্ছে, হবে৷’’
১৭ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সংগীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের একটি প্রতিবেদন৷ ‘বিনামূল্যে গান শোনাটাই অভ্যেস হয়ে যাবে না তো?’ – শিরোনামের প্রতিবেদনে শিল্পী তুলেছেন এই প্রশ্ন৷ ফেসবুকে লাইভ করে গান শোনাতে এলে শ্রোতারা প্রশংসা করছেন ঠিকই৷ কিন্তু শিল্পের মর্ম সেখানে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়৷ পাশাপাশি, সুদীপ্তর মতোই সেই প্রতিবেদনে লোপামুদ্রা তোলেন সংগীত জগতের সাথে জড়িত অসংখ্য সহযোগীর কথা, যারা সেভাবে মঞ্চে না উঠলেও আলো, ধ্বনি প্রক্ষেপণের মাধ্যমে শিল্পীকে সহায়তা করেন৷ তাদের রোজগারের প্রশ্ন লোপামুদ্রা তুলেছেন সেই প্রতিবেদনে৷ তিনি বলছেন তরুণ কর্মীদের কথা, যারা নিশ্চয়তা বাজি রেখে ভালোবাসার শিল্পের পথে এলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অসহায়৷ কিন্তু তবুও তিনি সেই প্রতিবেদনে বলেন, ‘‘আমি ইতিবাচক মনের মানুষ৷ নানা অসুবিধার মধ্যেও তাই ভালো দিকটাই মাথায় আসছে৷ হাজার কাজের ব্যস্ততায় এমনিতে রেওয়াজের সময় কম পাই, তাই এখন মন দিয়ে রেওয়াজটা করছি৷ অন্যদের গান শুনছি৷ গান নিয়ে কে কী ভাবছেন সেটাও জানা দরকার৷’’
সংকটের পরিবেশে শ্রোতা-শিল্পী একাকার
ফেসবুকে গান গাওয়ার-শোনার এই ‘ট্রেন্ড’ শ্রোতার পরিসরকেও বাড়িয়ে তুলেছে৷ ব্যস্ততমশিল্পীর কাছেও এখন পৌঁছে দিচ্ছে গান শুনতে পারার ফুরসতটুকু৷ শুধু তাই নয়, শিল্পীদের গ্ল্যামার ছাড়াও মানবিক, সাংসারিক দিক স্পষ্ট হচ্ছে এই সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমেই৷
শিল্পের বাজার ও শিল্পীর সম্মান ছাড়াও কিছু শিল্পীদের কথায় উঠে আসে বর্তমানের অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে সংঘবদ্ধতার কথা৷ সংগীতশিল্পী ও গবেষক সাহানা বাজপেয়ী ফেসবুকের পাশাপাশি ইন্সটাগ্রামেও নিয়মিত লাইভে এসে তাঁর গুণমুগ্ধদের গান শুনিয়েছেন৷ এছাড়া, অন্য শিল্পীদের অনুষ্ঠান সঞ্চালনাও করছেন৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি অবস্থাতেও সরাসরি গান শোনানোর মধ্যে একটা ব্যক্তিগত ছোঁয়া আছে৷ আমার ঘর থেকে অন্যের ঘরে পৌঁছে যেতে পারার বিষয়টা আছে৷ দর্শকরা আমাদের ঘরের দেওয়াল, বইয়ের তাক, একেবারে নিজস্ব পরিসরের কাছাকাছি এসে পড়েন, যা এতদিন পারেননি৷ এই নৈকট্য আমাদের গান গাওয়া ও শোনা একদম বদলে দিতে পারে৷ এটা কোনো মঞ্চ নয়, যেখানে শিল্পী আলোকিত, অথচ শ্রোতারা অন্ধকারে, এখানে আমরা সবাই সবার ঠিক পাশেই রয়েছি৷’’
কী বলছেন শ্রোতারা?
বাড়িতে বন্দি থেকে থেকে শিল্পীদের মতো শ্রোতারাও অতিষ্ঠ, মনমরা৷ তাই বেশির ভাগ শিল্পীর ফেসবুকে গান যেন সঞ্জীবনী ওষুধের মতো৷ কমেন্টে লেখেন, ‘দুঃসময়ের নিরাময়’ বা ‘মন ভালো হয়ে যায়’৷ শিল্পীর প্রচেষ্টাকে বাহবা দেন৷ সব মন্তব্য অবশ্য এক রকম নয়৷ অনেক শ্রোতা লাইভ ভিডিওতে লেখেন, ‘‘দুনিয়ায় লোক মরে, আর তুই গান শুনাস?’’
এখন পর্যন্ত পাল্লায় ভারী গানের মধ্যে নিরাময় খোঁজা শ্রোতারাই৷ কিন্তু এই একই শ্রোতা ভবিষ্যতে সঠিক পারিশ্রমিক দিয়ে শিল্পীর শ্রমের মর্যাদা দেবেন কিনা, তা এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব৷ শিল্পীদের ওপর দায়িত্ব কঠিন পরিস্থিতিকে তাঁদের শিল্পের সাহায্যে আরেকটু সহনীয় করে তোলার৷ শ্রোতার দায়িত্ব সেই মননের প্রতি আরেকটু শ্রদ্ধাশীল হওয়া৷