বাম-কংগ্রেস সমঝোতায় জট
১৪ মার্চ ২০১৯পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর শাসন ক্ষমতায় থাকা বামেদের শক্তি ক্রমশ কমেছে গত কয়েক বছরে৷ তার অনেক আগে থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির পর জাতীয় কংগ্রেসের জনসমর্থন একেবারে তলানিতে ঠেকেছে৷ এই দুই শক্তি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ২০১৬ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে আসন সমঝোতা করেছিল৷ তাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরানো না গেলেও অনেক কঠিন আসনে বিরোধী ভোটের ভাগাভাগি রুখে জয় পেয়েছিলেন বাম ও জাতীয় কংগ্রেসের জোট প্রার্থীরা৷ এপ্রিল ও মে মাসের লোকসভা নির্বাচনেও একই পথে হাঁটতে চাইছে দুই শিবির৷ কিন্তু ভোট ঘোষণা হয়ে গেলেও আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে পারেননি দু'দলের নেতারা৷ বারবার তাঁরা বৈঠকে বসলেও কে কোন আসনে লড়বে, তা এখনও ঠিক করা সম্ভব হয়নি৷
পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে বামফ্রন্ট ২৫ ও জাতীয় কংগ্রেস ১৭টিতে লড়বে, এই ফর্মুলা ঠিক হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু কার ভাগে কোন আসন যাবে, এ নিয়েই বোঝাপড়া হচ্ছে না৷ কাঁটা হয়ে রয়েছে প্রধানত দু'টি আসন, পুরুলিয়া ও বসিরহাট৷ পুরুলিয়ায় বামফ্রন্ট শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী দিতে চায়৷ এই কেন্দ্রে বাম ও কংগ্রেসের মিলিত ভোট তৃণমূলের থেকে অনেকটাই বেশি৷ জোট প্রার্থী লড়লে এই আসন তৃণমূলের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া সম্ভব৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফরওয়ার্ড ব্লক তৃতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেসকে আসন ছাড়তে রাজি নয়৷ বাম দলের রাজ্য সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায় কঠোর ভাষায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ওই কেন্দ্রে ২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলাম, কংগ্রেস ২২ শতাংশ৷ তাহলে কাদের লড়া উচিত? আমরা তিনটে আসনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বারাসত, পুরুলিয়া ও কোচবিহার৷ তার থেকে বড় কথা, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার মধ্যে আমরা থাকতে চাই না৷’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র পুরুলিয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রার্থীকে৷ পুরুলিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতো সেখানে কংগ্রেসের প্রার্থী হবেন৷ তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলকে বেগ দিয়েছে৷ এর সঙ্গে ইতিহাস জুড়ে সোমেন মিত্র বলেন, ‘‘পুরুলিয়া আগে বিহারের সঙ্গে ছিল৷ এই জেলাকে বাংলার মধ্যে সংযুক্ত করার আন্দোলনে নেপালের বাবা দেবেন মাহাতো নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ এই আবেগটা ভুলে গেলে চলবে না৷’’ উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট কেন্দ্র নিয়ে আরেক বাম শরিক সিপিআই-এর সঙ্গে টানাপোড়েন কংগ্রেসের৷ এই আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে রাজি নয় সিপিআই৷ তাদের বক্তব্য, এখানে মাত্র ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল কংগ্রেস৷ সিপিআই ছিল দ্বিতীয় স্থানে৷ সেই আসন কী ভাবে কংগ্রেসকে ছাড়া সম্ভব?
সমঝোতা নিয়ে টানাপোড়েনের সঙ্গে বাম ও কংগ্রেসের জোট নিয়ে আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন উঠছে৷ গত বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পর একাধিক কংগ্রেস বিধায়ক তৃণমূল বা বিজেপিতে চলে গিয়েছেন৷ তাহলে বাম সমর্থকরা কেন কংগ্রেসকে ভোট দেবেন৷ এ ব্যাপারে সিপিআই-এর রাজ্য সম্পাদক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই প্রশ্নটি খুবই সঙ্গত৷ এছাড়া এমনও দেখা গিয়েছে, কংগ্রেসের ভোট কিন্তু সেভাবে বাম প্রার্থীর দিকে আসে না৷ তাহলে জোটে আমাদের কী লাভ? তবু তৃণমূল ও বিজেপি বিরোধী ভোটে ভাগ রোখার জন্য সমঝোতার কথা ভাবা হয়েছে৷’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কংগ্রেস বিধায়করা তৃণমূলে গিয়েছেন ঠিকই, বাম বিধায়ক কি যাননি৷ এই সপ্তাহেই এক বাম বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন৷ বিরোধী বিধায়করা শাসকদলের চাপের মুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন৷ এটা অস্বীকার করা যাবে না৷’’ এ বিষয়ে সিপিএমের বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্যের মত, ‘‘এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক৷ কিন্তু কয়েকজন কংগ্রেস বা বাম বিধায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন বলে সবাই তা করবেন, এটা ভাবাও উচিত নয়৷ মানুষ ভবিষ্যতে ফের ভোটের ময়দানে তাঁদের সমুচিত জবাব দেবে৷’’
কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে লাভ নেই, এ কথা সিপিআই ও ফরওয়ার্ড ব্লক বললেও বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিএম-এর কী মত? তন্ময় ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘এই নির্বাচনের প্রধান লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানো৷ সেজন্য ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে একজোট হতে হবে৷ ভারতের নিরিখে কংগ্রেসকে এড়িয়ে এ ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ জোট গড়ে তোলার বাস্তব পরিস্থিতি আছে বলে আমরা মনে করি না৷’’