শাসকের বিরুদ্ধে ফুঁসছে সন্দেশখালি
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪৫ জানুয়ারি উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে গিয়ে আক্রান্ত হন ইডি কর্মকর্তারা। তারা রেশন দুর্নীতির তদন্তে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান করেছিলেন। এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত শেখ শাহজাহান ৩৩ দিন ধরে ফেরার, তার অনুপস্থিতিতে এক অন্য ছবি দেখা যাচ্ছে সন্দেশখালিতে।
গ্রামবাসীর রোষ
সন্দেশখালি এলাকার বেতাজ বাদশা হিসেবে পরিচিত শেখ শাহজাহান। ইডি আক্রান্ত হওয়ার পর শাসক দল দাবি করেছিল তদন্তকারীরা স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষের মুখে পড়েছে। কিন্তু মাস ঘুরতেই দেখা যাচ্ছে যে সেই শাহজাহানের অনুগামীরাই গ্রামবাসীদের তীব্র রোষের মুখে পড়েছেন।
বুধবার সন্দেশখালিতে তৃণমূলের মিছিল ছিল কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যকে বঞ্চনার প্রতিবাদে। এদিন পথে নামে আদিবাসী ও জমি বাঁচাও কমিটি। কাহারপাড়া, দাসপাড়া, পাত্রপাড়ার বাসিন্দারা লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল শুরু করেন। সেই মিছিলে যোগ দেন বিরোধী দলের সমর্থকরা। দুই মিছিল কাছাকাছি চলে এলে তীব্র উত্তেজনা ছড়ায়।
লাঠিসোটা নিয়ে তৃণমূলকর্মীদের তাড়া করেন গ্রামবাসীরা। তারা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন। প্রাণভয়ে পালাতে থাকে তৃণমূলের কর্মীরা। নৌকা করে পালানোর চেষ্টা করেন তাদের কয়েকজন। কিছুটা পিছনে পড়ে যাওয়া কয়েকজন ভাসমান নৌকায় উঠতে কালিন্দী নদীর জলে ঝাঁপ দেন। দড়ি বেয়ে নৌকায় উঠতে গিয়ে দুজন জলেও পড়ে যান।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ শেখ শাহজাহান ও তার দলবলের দৌরাত্ম্যে তারা দীর্ঘদিন নিজেদের জমিতে চাষ করতে পারেন না। সেচখাল বন্ধ করে তৃণমূল ভেড়ি তৈরি করলেও এ জন্য টাকা দেয়া হয়নি চাষিদের। জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তাদের। পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি।
বুধবার স্থানীয় মানুষজন শেখ শাহজাহানের ঘনিষ্ঠ দুই তৃণমূল নেতার বাড়িতে হামলা চালায়। শাসকদলের অঞ্চল সভাপতি উত্তম সর্দারের বাড়িতে চড়াও হয় হাজার দেড়েক গ্রামবাসী। ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম ভাঙচুর করা হয়। সেই সময় উত্তম বাড়িতে ছিলেন না।
পরে উত্তম ফিরলে তিনি আক্রমণের মুখে পড়েন। স্থানীয় জনতা তৃণমূল নেতাকে প্রচন্ড মারধর করে। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়। উত্তমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শেখ শাহজাহানের ঘনিষ্ঠ অপর নেতা শিবপ্রসাদ ওরফে শিবু হাজরার অফিসে ভাঙচুর চালায় গ্রামবাসী। তৃণমূলের এই নেতার পোল্ট্রি ফার্মে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এলাকায় না থাকায় রেহাই পান শিবু।
বাড়ছে উত্তেজনা
আজ বৃহস্পতিবার সকালেও সন্দেশখালিতে উত্তেজনা কমেনি। মহিলারা ঝাঁটা, লাঠি হাতে নিয়ে সন্দেশখালি থানার কাছাকাছি জমায়েত করেছেন। তাদের দাবি, শেখ শাহজাহান ও তার ঘনিষ্ঠদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।
পুলিশ কর্তারা ঘটনাস্থলে এসে গ্রামবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা জমায়েতে অনড়। প্রতিবাদের পুরোভাগে রয়েছেন গ্রামের নারীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষরা বিক্ষোভে যোগ দেন। গ্রামবাসী ক্ষোভ উগরে দেন পুলিশের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, দিনের পর দিন পুলিশকে অভিযোগ জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
পুলিশ জানিয়েছে, দুটি পৃথক অভিযোগ দায়ের হয়েছে বুধবারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদিও পুলিশের কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না গ্রামবাসী। তারা দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের দাবি, শাহজাহান, উত্তম ও শিবুকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।
তৃণমূল নেতা শাহজাহান কোথায় আছেন, তা নিয়ে নানা জল্পনার মধ্যে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে তার খাসতালুক। ইতিমধ্যে ফেরার নেতা আগাম জামিনের আবেদন জানিয়েছেন আদালতে। তার আর্জির নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই কি সন্দেশখালির মাটি ক্রমশ আলগা হচ্ছে দাপুটে নেতার পায়ের নীচে?
বিজেপি মুখপাত্র সজল ঘোষ বলেন, "সিপিএমের রাজত্বের শেষ সময় এভাবেই মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মানুষ অত্যাচারিত হতে হতে এবার প্রতিবাদ করছে।"
সন্দেশখালির তৃণমূল বিধায়ক সুকুমার মাহাতো চলতি উত্তেজনার জন্য বিরোধীদের দায়ী করেছেন। তার বক্তব্য, "আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিল হচ্ছিল। সিপিএম ও বিজেপি দল বেধে আমাদের কর্মীদের আক্রমণ করেছে। এটা গ্রামবাসীর কাজ নয়।"
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, "শুধু সন্দেশখালি নয়, রাজ্যের সর্বত্র মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে ফুঁসছে। তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছে গতকাল। এই প্রবণতা আরো ছড়িয়ে পড়বে।"
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "যেখানে মানুষ অত্যাচারের শিকার, সেখানে তারা যে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেন, তা সন্দেশখালি দেখিয়ে দিয়েছে। যারা রুখে দাঁড়াচ্ছেন না, নীরব আছেন, তারা ক্ষোভের প্রকাশ ভোটের মাধ্যমে করবেন কি না, তা বলে দেবে আগামী লোকসভা নির্বাচন।"
সিপিএমের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে নেতৃত্বে দেখা গিয়েছিল নারীদের। এখানেও সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সুমন বলেন, ‘‘তাম্রলিপ্ত থেকে নন্দীগ্রাম, নারীদের বারবার আন্দোলনের সামনের ভাগে দেখা গিয়েছে। এটা শাসকের পক্ষে বিপজ্জনক সংকেত।’’