নবজাতকের যকৃত প্রতিস্থাপন
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ন্যান্সি ভারলিশ মা হিসেবে তাঁর শিশুকন্যার জীবন বাঁচাতে ব্যাকুল হয়ে রয়েছেন৷ ছোট্ট লুইসে-র বয়স মাত্র ন'সপ্তাহ৷ ডাক্তাররা তার শরীরে এক দুরারোগ্য ব্যাধি চিহ্নিত করেছেন৷ বিরল এক রোগ নিয়ে তার জন্ম হয়েছে, যার ফলে যকৃত ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়৷ একমাত্র অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বাচ্চাটির জীবন বাঁচানো সম্ভব৷ ন্যান্সি বলেন, ‘‘মা হিসেবে শিশুর দুরারোগ্য ব্যাধির কথা শোনা সহজ নয়৷ জেনেছিলাম, আমার বাচ্চা বড়জোর তিন মাস বাঁচবে৷ অর্থাৎ কিছু করার জন্য মাত্র তিন মাস হাতে ছিল৷ তখন রাতারাতি হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিলাম৷’’
লুইসে-র মা বার্লিনের বিখ্যাত শারিটে হাসপাতালে ডাক্তারি পরামর্শ নিতে গিয়েছিলেন৷ অত্যন্ত জটিল এই রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের সম্মিলিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে৷ তাঁদের সিদ্ধান্তের উপর ছোট্ট মেয়েটির জীবন-মরণ নির্ভর করছে৷
লুইসে-র অবিলম্বে নতুন যকৃতের প্রয়োজন রয়েছে৷ কিন্তু শিশুদের জন্য সহজে দান হিসেবে উপযুক্ত অঙ্গ পাওয়া কঠিন৷ তাই মা-কেই তাঁর যকৃতের একটা অংশ দান করতে হবে৷ শিশু চিকিৎসক ড. ভ্যার্নার লুক বলেন, ‘‘গত শতাব্দীর আশির দশকে প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলাম৷ তখনও যকৃত প্রতিস্থাপন রুটিন অপারেশন হয়ে ওঠেনি৷ তখন দেখতে হয়েছিল, মাসের পর মাস কষ্ট পেয়ে কীভাবে শিশুরা মারা যেত৷ উপায় থাকলে কত ভালো হয়৷ কোনো বাবা-মাকে যখন বলতে হয় যে তাদের শিশুর রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, তার থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না৷’’
ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিলেন, যে লুইসে-র মা অঙ্গদানের যোগ্য হতে পারেন৷ কিন্তু সেই লক্ষ্যে তাঁকে কঠিন এক অপারেশন করাতে হবে, যার ফলে তাঁর নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে৷ ন্যান্সি ভারলিশ বলেন, ‘‘মনের মধ্যে ঝুঁকিগুলি চেপে রাখার চেষ্টা চলে৷ বলা যায়, কোনো অবস্থায় আমি এমন ঝুঁকি নেবো না৷ বড় ভয় করছে৷ কিন্তু তাহলে তো বলতে হয়, আমার মেয়ের জীবনের পরোয়া করি না৷ কারণ তার তো স্বাভাবিক জীবনের আশা নেই৷ তার মৃত্যু তো অনিবার্য৷ সে কারণেই আমি বলি, তার বেঁচে থাকার সুযোগ পাওয়া উচিত৷’’
গেরো পুল এই অপারেশন করবেন৷ ৪৪ বছর বয়স্ক এই সার্জেন এর মধ্যে প্রায় ৪০০ বার যকৃত প্রতিস্থাপন করেছেন৷ কিন্তু এমন অভিজ্ঞ শল্যচিকিৎসকের জন্যও এমন অপারেশন এক বড় চ্যালেঞ্জ৷
বার্লিনের শারিটে হাসপাতালে ডাক্তারদের টিম এক জটিল অপারেশন শুরু করলো৷ প্রতিস্থাপনের জন্য মায়ের যকৃতের প্রায় এক-অষ্টমাংশের প্রয়োজন৷ প্রকৃতির এক আশ্চর্য প্রক্রিয়ার কারণে এমন প্রতিস্থাপন আদৌ সম্ভব হয়েছে৷ কারণ যকৃতই একমাত্র অঙ্গ, যা আবার বেড়ে উঠতে পারে৷ সবকিছু ঠিকমতো চললে মাত্র ছ'সপ্তাহের মধ্যে যকৃত আবার তার স্বাভাবিক আয়তন ফিরে পেতে পারে৷ শল্যচিকিৎসক প্রো. গেরো পুল বলেন, ‘‘জীবন্ত অবস্থায় যকৃত প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো একটি মুহূর্ত নয়, গোটা অপারেশনই অত্যন্ত জটিল৷ আপনি জানেন, যে সুস্থ এক মানুষ অপারেশ টেবিলে শুয়ে রয়েছেন৷ এই মানুষটির সঙ্গে কোনো খারাপ কিছু হতে দেওয়া যায় না৷’’
মায়ের অপারেশনের পাশাপাশি একই সঙ্গে ডাক্তাররা সন্তানের বিকল যকৃত বার করে নেন৷ জার্মানিতে বছরে মাত্র ২০ বারের মতো এমন অপারেশন হয়৷ গেরো পুল হাতে গোনা কয়েকজন সার্জেনদের মধ্যে পড়েন, যাঁদের এই জটিল অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ নিজের আবেগ চেপে রাখতে পারলেই পেশাদারিত্বের সঙ্গে তিনি কাজ করতে পারেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এমন এক অপারেশনের জন্য ভালো প্রস্তুতির প্রয়োজন, বিশেষ করে মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে৷ ঠিকমতো অনুশীলনের পর আপনি দ্রুত ভুলে যাবেন, যে আপনি এক শিশুর অপারেশন করছেন৷ তখন শুধু কাজে মন দেবেন এবং পুরোটা সময় ধরে সদ্যোজাত শিশুর কথা ভাববেন না৷ নিজের সন্তান থাকলে আরও কষ্ট হয়, কিন্তু সেটা হতে দেওয়া উচিত নয়৷’’
এবার সেই মুহূর্ত এসে গেছে৷ ডাক্তাররা রক্ত চলাচল বন্ধ করে মায়ের যকৃতের অংশ কেটে নিলেন৷ তারপর অতি সাবধানতার সঙ্গে সার্জেন সেটি পাশের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন৷ শিশুর শরীর থেকে বিকল যকৃত সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ এবার সবচেয়ে কঠিন কাজের পালা৷ গেরো পুল রক্তবাহী শিরা সেলাই করছেন৷ অত্যন্ত সূক্ষ্ম সেই কাজ৷ সব শিরা ও ধমনি নিখুঁতভাবে জোড়া হলে যকৃত তবেই স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবে৷ ডাক্তাররা গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন৷
প্রায় আট ঘণ্টার পর ডাক্তাররা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন৷ অপারেশন সফল হয়েছে৷ ছোট্ট লুইসে এখনো ডাক্তারি নজরদারির মধ্যে রয়েছে৷ তবে আসল বিপদ কেটে গেছে৷