সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দিতে অনীহা
৭ মার্চ ২০২২এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে কয়েকবার কথা বলেছেন। সরকারি কর্মচারীরা কেন এই সিদ্ধান্তকে পাত্তা দিচ্ছেন না? তারা কী আইনের উর্ধ্বে?
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকারের তরফ থেকে বারবার চিঠি দেওয়া হবে আর কর্মচারীরা সেটা মানবেন না তা হতে পারে না। তারা তো স্বাধীন না। কোন কর্মচারী যদি সিদ্ধান্ত না মানেন তাহলে তার উর্ধ্বতন তাকে শাস্তির আওতায় আনবেন। তবে একটা বিষয় বুঝতে হবে, এতবার চিঠি দেওয়ার পরও কেন এটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। হয় এটা বাস্তাবায়নযোগ্য না, অথবা সরকার এটা বাস্তবায়ন করতে চায় না। সরকার চাইলে এটার বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে দশম গ্রেডের উপরে যারা চাকরি করে তারা কিন্তু প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। সেখানে তাদের সম্পদের বিবরণ থাকে। এখন সরকার চাইলে সেখান থেকেও এটা নিতে পারে। তবে আইনে কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর অন্তর হিসাব দাখিলের কথা।”
সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নতুন নির্দেশনা দিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, "সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর আওতাভুক্ত সব সরকারি কর্মকর্তা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে সম্পদ বিবরণী দাখিল, উক্ত সম্পদ বিবরণী ডাটাবেজ তৈরি এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে স্থাবর সম্পত্তি অর্জন/বিক্রয়ের বিষয়ে ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর ১১, ১২ ও ১৩ বিধি প্রতিপালন পূর্বক এ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে পুনরায় অনুরোধ করা হলো।” এর আগে গত বছরের ২৪ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-৪ শাখার চিঠি থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
বারবার চিঠি দেওয়া হলেও কেন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বাস্তবায়ন হয় না যে তা নয়। প্রতি বছর কিন্তু কর্মকর্তারা আয়কর রিটার্ণ দাখিল করেন। সেখানে তাদের সম্পদের বিবরণ থাকে। এখন যে সমস্যটা হয়েছে আইনে বলা আছে, পাঁচ বছর অন্তর অন্তর, কিন্তু আমরা কর্মকর্তারা প্রতি বছর এটা দাখিল করছি। এখন পাঁচ বছরের হিসাব কম্পাইল করার একটা চেষ্টা আমরা করছি। আমরা বলছি, প্রতি বছর যে হিসাবটা তারা দাখিল করছে, পাঁচ বছর পরপর এটা কম্পইল করে জনপ্রশাসনে আবার দাখিল করবে। এটা নির্ধারণ করে আমরা কাজ করছি, এটা এগুচ্ছে। কিছু জটিলতা আছে। আমরা চিন্তা করছি, যে রিটার্ন দাখিল করা হবে সেটা অনলাইনে এখানে চলে আসতে পারে কিনা। এটা নিয়ে কাজ চলছে, দেখা যাক।”
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই হিসাব বিবরণী জমা দিলেও যন্ত্রণা আছে। আমি যখন মন্ত্রীপরিষদ সচিব ছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তখন কিন্তু সব কর্মচারীর কাছ থেকে সম্পদের হিসাব নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখা গেল, এটা যাচাই-বাছাই করার সক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে শুধু বিবরণী নিলেই তো হবে না, যাচাই বাছাই করে দেখতে হবে। আরেকটা বিষয় কর্মকর্তারা তো আয়কর রিটার্ন দিচ্ছেন, সেটার সঙ্গে এটার কীভাবে সমন্বয় করা যায় সেটাও ভেবে দেখা যেতে পারে। বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিলে এটা করা সম্ভব। এখন জমা না দেওয়ার যে কালচার গড়ে উঠেছে, সেই কারণেই কর্মচারীরা এটা দিচ্ছেন না। ঢালাওভাবে তাদের দোষ দিলেও হবে না।”
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময় এই আইনটি প্রণয়ন করেছিলেন। এরপর ২০০২ ও ২০১১ সালে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় নির্দেশনাগুলো সংশোধন করা হয়নি। তাই ২০১৪ সালে ফের সংশোধন কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু আট বছরেও তা শেষ করতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত বছর আচরণ বিধিমালা সংশোধন বিষয়ে কয়েকটি কর্মশালা আয়োজন করা হয়। কিন্তু কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়ে পরিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এই আচরণ বিধিমালায় মোট ৩৪টি নির্দেশনা আছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সম্পদের হিসাব দেওয়ার অনীহা কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। যারা সম্পদের হিসাব দেন না, তারা কি কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন?” সরকারী কর্মকর্তারা তো প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন দিচ্ছেন তাহলে আলাদা করে কেন হিসাব দিতে হবে? সরকার তো চাইলেই এনবিআর থেকে এই হিসাব নিতে পারে? জবাবে জনাব ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "এটা কোন যুক্তি হলো না। এটা তো আইনের মধ্যেই আছে, তাকে পাঁচ বছর পরপর হিসাব দিতে হবে। এই বাধ্যবাধকতা কেন করা হয়েছে? নিশ্চয় এর সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। সেটা হল বৈধ আয়ের পাশাপাশি কোন অবৈধ আয় আছে কিনা সেটা সরকারের তরফ থেকে দেখা হবে। সম্পদের হিসাব দাখিল না করে অন্য যে কোন যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।”
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দুই দফা নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীরা সম্পদের হিসাব দাখিল করবেন। এটা তো বাস্তবায়ন করা হয় না। ফলে অন্যগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আসলে আমাদের গোপনীয়তার সস্কৃতির কারণে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কোন কিছু প্রকাশ করা হলেও সেখানে ত্রুটি থেকে যায়।” ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, "যারা সম্পদের হিসাব চেয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন, আগে তাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এতে অধস্তন কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা বার্তা যাবে।