সর্বস্বান্ত হয়েও নাগরিকত্ব প্রমাণ করা গেল না
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০শেষ সম্বল খরচ করে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে নেমেছিলেন তিনি৷ আইনি লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন৷ আসামের হাইকোর্ট জুবেদা বেগমের বিরুদ্ধে রায় দিল। এ বার একমাত্র সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন জুবেদা৷ কিন্তু হাতে আর টাকা নেই তাঁর৷
আসামের এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে জুবেদা। নাগরিকত্ব প্রমাণ করার লড়াইয়ে নেমে বিক্রি করে দিয়েছেন শেষ জমিটুকুও। দীর্ঘ দিন ধরে আসামের হাইকোর্টে আইনি লড়াই চালাচ্ছিলেন তিনি। নাগরিকত্বের ১৫টি প্রমাণ আদালতকে জমা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গুয়াহাটি হাইকোর্ট শেষ পর্যন্ত জানিয়েছে, এত কিছুর পরেও নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেননি জুবেদা বিবি৷ কারণ, বাবা এবং ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি৷
ভোটার আই কার্ডে নিজের নাম, '৬৬ সাল থেকে বাবার ভোট দেওয়ার নথি, ভূমি রাজস্ব দেওয়ার রশিদ, বিয়ের সার্টিফিকেট, গ্রামের প্রধানের হলফনামা, প্যান কার্ড, রেশন কার্ডের মতো ১৫টি প্রমাণপত্র জমা দিয়েছিলেন জুবেদা৷ কিন্তু অসমের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা জুবেদা বেগমকে বিদেশি বলেই চিহ্নিত করেছিল ফরেনার্স ট্রাইবুনাল৷ হাইকোর্টও তাঁর আবেদন খারিজ করে দিল। নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য জুবেদার সামনে এখন একটাই পথ, সুপ্রিম কোর্টে আবেদন৷ কিন্তু সেই আবেদন করার মতো আর্থিক সঙ্গতি আর তাঁর নেই।
জুবেদার তিন বিঘে জমি ছিল৷ হাইকোর্টে আইনি লড়াইয়ের খরচ যোগাতে তা বিক্রি করতে হয়েছে৷ স্বামী অসুস্থ৷ বড় মেয়ে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন৷ মেজো মেয়ে নিখোঁজ৷ ছোট মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে৷ বাকসা জেলার তামুলপুর গ্রামের জুবেদার সমস্ত চিন্তা এখন ছোট মেয়েকে ঘিরে৷এখন জনমজুরের কাজ করেন জুবেদা৷ সেই রোজগারেই সংসার চলে। সাংবাদিককে জুবেজা জানিয়েছেন, ছোট মেয়ে অভুক্ত থেকে শুয়ে পড়লে সব চেয়ে কষ্ট হয় তাঁর।
জুবেদার আইনজীবী জানিয়েছেন, ''আসলে তিনি যখন ভোটার তালিকায় নাম তোলেন, তখন সেখানে বাবা নয়, স্বামীর নাম দিয়েছিলেন। তাই হাইকোর্ট বলছে, তিনি সম্পর্ক প্রমাণ করতে পারেননি৷ তবে গ্রাম প্রধানের সার্টিফিকেটও বৈধ নথি৷ তার ভিত্তিতে জুবেদা নাগরিকত্ব পেতে পারেন৷'' কিন্তু আইনজীবীর কথা এখানে মুখ্য নয়, আদালত কী বলেছে সেটাই প্রধান৷
তা হলে এ বার জুবেদা বেগমের কী হবে? অসমে এনআরসি নিয়ে একেবারে গোড়া থকে কাজ করছেন সাংবাদিক অমিত সেনগুপ্ত৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''অসমে এরকম হাজার হাজার জুবেদা আছেন৷ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আছেন৷ রাজবংশীরা একইভাবে ভুগছেন৷ বোড়োরাও৷ মেয়েদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ৷ তাদের বেশিরভাগই লেখাপড়া শেখেননি৷ কোনও প্রমণপত্র নেই৷ আরেকটা সমস্যা হল, প্রতি বছর বন্যা হয়৷ পুরো গ্রাম বন্য়ায় মুছে যায়৷ ওই গ্রামের বাসিন্দারা অন্যত্র বসতি স্থাপন করেন৷ বন্যার জলে ঘরে থাকা সবকিছুই ভেসে য়ায়৷ গ্রামের নামও আর থাকে না৷ তাঁরা কোথা থেকে প্রমাণপত্র পাবেন?''
অসমীয়া প্রতিদিনের প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''এই সমস্যায় আসামের প্রচুর মহিলা, বিশেষ করে মুসলিম মহিলারা পড়েছেন৷ তাঁদের অধিকাংশই অশিক্ষিত৷ তাঁরা যখন প্রমাণপত্রের জন্য আবেদন করেন, সেটাও অন্য লোকে লিখে দেন৷ ভোটার আই কার্ডে বাবার নাম না লিখে শুধু স্বামীর নাম লেখার কারণ সেটাই৷ বিয়ের পর যখন তাঁরা স্বামীর ঘরে যান, তখন গ্রাম প্রধানের সার্টিফিকেট ছাড়া কিছু থাকে না৷ শেষ পর্যন্ত সম্ভবত ডিটেনশন ক্যাম্পেই যেতে হবে জুবেদাদের।''
এটা কেবল আসামের জুবেদার সমস্যা বলে মনে করল ভুল হবে৷ আসামে প্রচুর মানুষ এই সমস্যায় পড়েছেন৷ পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের অন্য রাজ্যেও বহু মানুষ এই আতঙ্কে ভুগছেন৷ দেশজুড়ে এনআরসি চালু হলে তাঁরা কীভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করবেন, সেটাই তাঁদের চিন্তা৷ এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্টজনদের একটা বড় অংশ বলেছেন, তাঁরা কাগজ দেখাবেন না৷ নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী যেমন ডয়েচে ভেলেকে বলেছিলেন, নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তিনি কোনও কাগজ দেখাবেন না৷
কাগজ না দেখানোর রব শাহিনবাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যে সিএএ-এনআরসি নিয়ে প্রতিবাদকারীদের মুখে মুখেও ঘুরছে। ভারতীয় হয়ে কেন আবার নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে? এই প্রসঙ্গেই জুবেদার কাহিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়৷ সেটা আর শুধুমাত্র একা মানুষের সমস্যা থাকে না৷
জিএইচ/এসজি (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এনডিটিভি)