'বিতর্কিত' এনআরসি হবেই, বলছে বিজেপির পুস্তিকা
২৮ জানুয়ারি ২০২০এনআরসি নিয়ে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত ছিলেনই। এ বার বিভ্রান্তি ভারতের শাসক দল বিজেপির অন্দরেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বয়ানের সঙ্গে মিলছে না বিজেপির দলীয় পুস্তিকার বয়ান। তবে বিরোধীরা বলছেন, এই বিভ্রান্তি আসলে ইচ্ছে করেই তৈরি করছে বিজেপি। এটাই তাদের ভোট কৌশল।
দেশ জুড়ে সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত। তারই মধ্যে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভা কিংবা প্রশাসনে এনআরসি নিয়ে কোনও কথাই হয়নি। অথচ বিজেপির প্রচার পুস্তিকায় এখনও জ্বলজ্বল করছে এনআরসি-র কথা। যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে, সিএএ হয়ে যাওয়ার পরে দেশ জুড়ে এনারসি হবে। এটাই কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত।
ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএএ সংসদে পাশ হওয়ার পরেই দেশ জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। একদিকে রাস্তায় নেমেছে ছাত্র এবং নাগরিক সমাজ। অন্য দিকে রাজ্যে রাজ্যে এই আইনের বিরোধিতা করছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। বেশ কয়েকটি রাজ্য বিধানসভায় সিএএ বিরোধী প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। কেরালার মতো রাজ্য আইনটির বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টেও গিয়েছে। বিরোধীদের বক্তব্য, সিএএ পাশ করার পরে সরকার এ বার দেশ জুড়ে এনআরসি করবে। যা কেবল অসাংবিধানিক নয়, বিভেদমূলক। আসামে এনআরসি-র ফলে ১৯ লক্ষ মানুষ ঘোর বিপাকে পড়েছেন। অনেককেই পাঠানো হয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিরোধীরা লাগাতার বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন।
গত এক বছর ধরে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহও একাধিকবার বলেছেন, সিএএ পাশ হয়ে গেলেই এনআরসি করা হবে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে দেশ থেকে বার করে দেওয়া হবে। কিন্তু সিএএ পরবর্তী আন্দোলনের উত্তাপ দেখে সম্ভবত এক পা পিছনে গিয়েছে সরকার। জনসভা করে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এনআরসি নিয়ে সরকার কোনও আলোচনাই করেনি। বিরোধীরা মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন। মোদী এ কথা বলার পরে শাহও একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। নিজের পুরনো বয়ানও বদলে ফেলেছেন। বিরোধীদের দাবি, এক এক সময় এক এক রকম বয়ান দিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন মোদী-শাহ।
শুধুই কি দেশবাসী? মোদী-শাহের বয়ানে কার্যত বিভ্রান্ত বিজেপিও। সিএএ পাশ হওয়ার পরে আইনটির সারবস্তু সাধারণ মানুষকে জানানোর জন্য সম্প্রতি একটি পুস্তিকা বার করেছে বিজেপি। প্রায় সব ভাষাতেই সেই পুস্তিকা ছাপা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যে বাংলা পুস্তিকাটি তারা বিলি করছে তাতে স্পষ্টই বলা হয়েছে, সরকার এনআরসি করবে। এটি সরকারের ঘোষিত সিদ্ধান্ত।
বিরোধীদের প্রশ্ন, তাহলে কে মিথ্যে? মোদী, না কি তাঁর দলের পুস্তিকা? তৃণমূল সাংসদ মানস ভুঁইঞার অভিযোগ, ''বিজেপি এবং তাদের সরকার মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ কাজ করছে। এনআরসি নিয়ে তারা একটি ধোঁয়াশা তৈরি করে আপাতত আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি অনুকূল হলেই তারা এনআরসি করবে। সংসদে এ বিষয়ে সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হবে।''
বঙ্গ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু অবশ্য বলেছেন, ''প্রধানমন্ত্রীর বয়ানের সঙ্গে আমাদের পুস্তিকার বয়ানের কোনও বিরোধ নেই। বিজেপি বহু দিন ধরেই এনআরসি করতে চাইছে। এটা আমাদের ঘোষিত সিদ্ধান্ত। নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, এখনই এনআরসি করার কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ভবিষ্যতেও হবে না, এমন কথা তিনি বলেননি। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা হবেই। এনআরসিও হবে।''
২০১৯ এর নির্বাচন পর্বে অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে গিয়ে ঠিক এই কথাটিই বলেছিলেন। দাবি করেছিলেন, সিএএ হয়ে গেলেই এনআরসি করা হবে। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনী প্রচারে গিয়েও একই কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী রামলীলা ময়দানে এনআরসি নিয়ে উল্টো সুর গাওয়ার পরে শাহও নিজের বয়ান বদলে ফেলেছেন। তাঁর টুইটার হ্যান্ডেল থেকেও রাতারাতি এনআরসি সংক্রান্ত সমস্ত বক্তব্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মজার বিষয় হল, সিএএ নিয়ে হিন্দিতে যে পুস্তিকা বার করেছে বিজেপি, সেখানে এনআরসির কথা নেই। কিন্তু বাংলায় আছে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই এ কাজ করেছে বিজেপি। তারা জানে, বাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণের অস্ত্র ব্যবহার না করলে তাদের পক্ষে ভোট পাওয়া মুশকিল। তাই এনআরসির কথা বলে মেরুকরণ বজায় রাখতে চাইছে তারা। কিন্তু বাকি দেশে এনআরসি নিয়ে বিক্ষোভ বন্ধ করতে চাইছে। তাই হিন্দি পুস্তিকা থেকে এনআরসি প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে।