1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সামনে কি এক স্থবির ঢাকা?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৭ আগস্ট ২০১৭

ঢাকার যানজট নিয়ে নানা কথা হয়েছে, হয়েছে গবেষণা আর যানজট কমাতে হয়েছে মহাপরিকল্পনাও৷ আগে বলা হতো ফ্লাইওভার নির্মাণ করলেই যানজট কমবে৷ কিন্তু না, তেমনটা হয়নি৷ তাই এবার যানজট কমাতে ঢাকার সড়কে করা হচ্ছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা৷

https://p.dw.com/p/2hjuQ
ছবি: picture-alliance/dpa

গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের গবেষণা তুলে ধরা হয়৷ সেই গবেষণায় জানানো হয় যে, ঢাকায় শুধু যানজটের কারণে প্রতিবছর ক্ষতি হয় অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা৷ ঢাকায় এখন আর কোনোমতেই ঘণ্টায় গড়ে সাত কিলোমিটারের বেশি গতি পায় না যন্ত্রচালিত যানবাহন৷ বিশ্লেষকদের কথায় অবশ্য এই গতি গড়ে ছয় কিলোমিটারের বেশি হবে না৷ বলা বাহুল্য, এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ চার কিলোমিটারের বেশি গতিতে ছুটতে পারবে না যানাবাহন৷ এই যে গতির হিসাব, তাতে এখনই যানবাহনের চেয়ে পায়ে হেঁটে আগে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়৷ তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সামনে কি এক স্থবির ঢাকা অপেক্ষা করছে?

সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ প্রাইভেট কার৷ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসেবে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বাস ও মিনিবাসের চেয়ে সাত গুণ বেশি চলেছে প্রাইভেট কার৷

‘এখানে নিয়ম না মানার শীর্ষে প্রাইভেট কার, তারা ইচ্ছে মতো চলাচল করে’

‘২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার উন্নয়ন সম্ভাবনা' শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেছেন, ‘‘১০ বছর আগেও ঢাকায় যানবাহনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার৷ এখন সেই গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারেরও কম৷ যে হারে ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আর ক'বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি কার্যত নাগালের বাইরে চলে যাবে৷' আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মেলনে যানজট নিরসনে মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি), বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা জানানো হয়৷

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, ঢাকার এখনকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ৷ ২০৩৫ সালে তা দ্বিগুণ হয়ে সাড়ে ৩ কোটি হবে৷

যোগাযোগ মন্ত্রীর সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থ বছরে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ১৮টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়৷ গত ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকায় মোট গাড়ির সংখ্যা ১১ লাখ ২৫ হাজার৷ তবে ২০১৫ সালে সংসদে দেয়া তথ্য মতে, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে নতুন গাড়ি নামছে ৩১৭টি৷ এরমধ্যে ৫৩টি প্রাইভেট কার৷

ঢাকা শহরে বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, হিউম্যান হলার, অটোরিকশা, মটর বাইক ও  ট্রাকসহ নানা যান্ত্রিক যানবাহন একসঙ্গে চলে৷ এর সঙ্গে আছে রিকশা, ভ্যান ও সাইকেলের মতো নানা অযান্ত্রিক যানবাহনও৷ এমনকি ঢাকার কিছু এলাকায় এখনো চলে ঘোড়ার গাড়ি৷

অন্যদিকে ঢাকায় সড়কের পরিমাণ মোট আয়তনের সাত ভাগের বেশি নয়৷ কিন্তু একটি শহরে মোট আয়তনের কমপক্ষে ৩০ ভাগ সড়ক থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ এর মানে হলো, প্রয়োজনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এই শহরে৷ ঢাকা শহরের মোট এলাকা ১,৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার আর ঢাকার বর্তমান রাস্তার আয়তন ২,২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক৷

তাই চিত্রটি খুবই স্পষ্ট৷ প্রয়োজনের তুলনায় সড়ক অনেক কম৷ বিপরীতে যানবাহন বেড়েছে গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি৷ এছাড়া যে সড়ক আছে তার কমপক্ষে ১৫ ভাগ নানাভাবে অবৈধ দখলে আছে৷

ঢাকায় ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের ৭০ ভাগ৷ স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি-র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট কারে যাতায়াত করেন৷ এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা৷ বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন৷ অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পায়৷ জনসংখ্যার হিসেবে শতকরা এক ভাগের মতো মানুষের প্রাইভেট কার আছে৷ কিন্তু সড়ক চলে গেছে তাদের দখলে৷

সরকারি গণপরিবহনের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি ৩৩ গুণ বেশি থাকলেও এ সব ব্যক্তিগত গাড়িতে মাত্র ১৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা হয়৷ বাস ৪৯ শতাংশ যাত্রীর দায়িত্ব নেয়৷

ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে এখনো রেলগাড়ি চলাচল করে৷ ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে রেল লাইন যাওয়ার ফলে ১৭টি পয়েন্টে রাস্তা বন্ধ করে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়৷ এ সব পয়েন্টে দিনে কমপক্ষে ১০ বার যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়৷

সরকারের পরিকল্পনা

এ সব সমস্যা সমাধানে সরকার ২০১৪-১৫ সালে একটি রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) অনুমোদন করে, যাতে পাঁচটি পাতাল রেললাইন, দু'টো দ্রুতগতির বাস রুট এবং ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷ আর তা বর্তমান সড়ক নেটওয়ার্কের দ্বিগুণ৷ এতে ছয়টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং তিনটি রিং রোড অন্তর্ভুক্ত আছে৷ আগামী ২০ বছরে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের মোট ব্যয় হবে প্রায় ৩ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা৷

খসড়া পরিবহন পরিকল্পনায় আরো ৩ লাখ ৬০ হাজার অতিরিক্ত গাড়ি রাস্তায় নামানোর কথা বলা হয়েছে, যা অনেক বেশি পরিমাণে জায়গা দখল করবে৷ এ সব গাড়ি শুধু পার্ক করার জন্যই ৩ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার জায়গার প্রয়োজন হবে, যা গুলশান এবং বনানী আবাসিক এলাকার মিলিত আয়তনের প্রায় সমান৷

পুলিশ কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা

ঢাকার এই পরিবহণ সমস্যা এবং যানজট নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে৷ গবেষকরা নানা মতামতও দিচ্ছেন৷ তবে ঢাকার এক পুলিশ কর্মকর্তা আবু ইউসুফ প্রায় দু'বছর ধরে ঢাকার একটি এলাকার পরিবহণ ব্যবস্থা এবং যানজট নিরসনের জন্য তাঁর নিজের উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে সফলতা পান৷ এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদনও প্রচার হয়েছে৷ তিনি ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ঢাকা উত্তর বিভাগে ট্রাফিক পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ তাঁকে তেজগাঁ শিল্প এলাকা, মগবাজার, রামপুরা

এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল৷ আর এই এলাকাগুলোতে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার সব কারণ বিদ্যমান৷ এখানে রেলক্রসিং, ফ্লাইওভার, যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহন, প্রাইভেট কারের আধিক্য সব কিছুই আছে৷

তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকাসহ সব সমস্যা মেনে নিয়েও শুধুমাত্র নিয়ম মানার মধ্য দিয়ে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার অনেক উন্নতি সম্ভব৷ এখানে নিয়ম না মানার শীর্ষে প্রাইভেট কার৷ তারা ইচ্ছে মতো চলাচল করে৷ আমি ডানের গাড়ি ডানে, বামের গড়ি বামে – এই নীতি অবলম্বন করে আমার এলাকায় যানজট অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিলাম৷ তাছাড়া রাস্তায় ঘন ঘন ক্রসিং বন্ধ করেও সুফল পেয়েছি৷’’

পথচারীরাও যানজটের একটা প্রধান কারণ৷ তারা যদি আন্ডার পাস অথবা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন তাহলে যানবাহনের গতি বাড়ে৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি নিজে রাস্তায় নেমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করেছি৷ মানুষকে বুঝিয়েছি, প্রচারণা চালিয়েছি সচেতন করেছি৷ রিক্সার জন্য আলাদা লেন করেছি৷ কারণ যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন একই সড়কে চললে গতি কমতে বাধ্য৷’’

তাই ‘‘আমার বিবেচনায়, গাড়ি চলাচলে ডান-ডান, বাম-বাম নীতি না মানা, একই সড়কে যান্ত্রিক অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল, রাস্তায় নির্মাণ কাজ, খোড়াখুড়ি, রাস্তায় পার্কিং, ঘন ঘন ক্রসিং এবং ট্রফিক আইন অমান্য করা, উলটোপথে গাড়ি চালানো যানজটের প্রধান কারণ৷ এর সাথে আছে রাস্তার সমতা না থাকা৷ চওড়া সড়ক যখন সরু সড়কে গিয়ে মেশে তখন যানজট তো হবেই৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের এখন যা আছে তা দিয়েই আমি সমস্যার সমাধান খুঁজেছি৷ বর্তমান কাঠামোর মধ্যেই ট্রাফিক ব্যবস্থা আরো কীভাবে ভালো করা যায় আমি তার চেষ্টা করেছি৷ আর কাঠামোগত সংস্কারসহ আরো অনেক বিষয়ের কথা বলতে পারবেন বিশেষজ্ঞরা৷’’

বলা বাহুল্য, ঢাকার যে ট্রাফিক চিত্রের কথা বলা হলো, তা স্বাভাবিক পরিস্থিতি৷ কিন্তু জলাবদ্ধতা, বৃষ্টি বা বিশেষ পরিস্থিতিতে কী হতে পারে বা হয়, তা মনে হয় গবেষণায়ও বোঝা কঠিন৷ 

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান