সামনে কি এক স্থবির ঢাকা?
৭ আগস্ট ২০১৭গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের গবেষণা তুলে ধরা হয়৷ সেই গবেষণায় জানানো হয় যে, ঢাকায় শুধু যানজটের কারণে প্রতিবছর ক্ষতি হয় অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা৷ ঢাকায় এখন আর কোনোমতেই ঘণ্টায় গড়ে সাত কিলোমিটারের বেশি গতি পায় না যন্ত্রচালিত যানবাহন৷ বিশ্লেষকদের কথায় অবশ্য এই গতি গড়ে ছয় কিলোমিটারের বেশি হবে না৷ বলা বাহুল্য, এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ চার কিলোমিটারের বেশি গতিতে ছুটতে পারবে না যানাবাহন৷ এই যে গতির হিসাব, তাতে এখনই যানবাহনের চেয়ে পায়ে হেঁটে আগে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়৷ তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সামনে কি এক স্থবির ঢাকা অপেক্ষা করছে?
সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ প্রাইভেট কার৷ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসেবে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বাস ও মিনিবাসের চেয়ে সাত গুণ বেশি চলেছে প্রাইভেট কার৷
‘২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার উন্নয়ন সম্ভাবনা' শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেছেন, ‘‘১০ বছর আগেও ঢাকায় যানবাহনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার৷ এখন সেই গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারেরও কম৷ যে হারে ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আর ক'বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি কার্যত নাগালের বাইরে চলে যাবে৷' আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মেলনে যানজট নিরসনে মাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি), বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা জানানো হয়৷
বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, ঢাকার এখনকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ৷ ২০৩৫ সালে তা দ্বিগুণ হয়ে সাড়ে ৩ কোটি হবে৷
যোগাযোগ মন্ত্রীর সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থ বছরে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ১৮টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়৷ গত ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকায় মোট গাড়ির সংখ্যা ১১ লাখ ২৫ হাজার৷ তবে ২০১৫ সালে সংসদে দেয়া তথ্য মতে, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে নতুন গাড়ি নামছে ৩১৭টি৷ এরমধ্যে ৫৩টি প্রাইভেট কার৷
ঢাকা শহরে বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, হিউম্যান হলার, অটোরিকশা, মটর বাইক ও ট্রাকসহ নানা যান্ত্রিক যানবাহন একসঙ্গে চলে৷ এর সঙ্গে আছে রিকশা, ভ্যান ও সাইকেলের মতো নানা অযান্ত্রিক যানবাহনও৷ এমনকি ঢাকার কিছু এলাকায় এখনো চলে ঘোড়ার গাড়ি৷
অন্যদিকে ঢাকায় সড়কের পরিমাণ মোট আয়তনের সাত ভাগের বেশি নয়৷ কিন্তু একটি শহরে মোট আয়তনের কমপক্ষে ৩০ ভাগ সড়ক থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ এর মানে হলো, প্রয়োজনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এই শহরে৷ ঢাকা শহরের মোট এলাকা ১,৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার আর ঢাকার বর্তমান রাস্তার আয়তন ২,২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক৷
তাই চিত্রটি খুবই স্পষ্ট৷ প্রয়োজনের তুলনায় সড়ক অনেক কম৷ বিপরীতে যানবাহন বেড়েছে গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি৷ এছাড়া যে সড়ক আছে তার কমপক্ষে ১৫ ভাগ নানাভাবে অবৈধ দখলে আছে৷
ঢাকায় ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের ৭০ ভাগ৷ স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি-র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট কারে যাতায়াত করেন৷ এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা৷ বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন৷ অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পায়৷ জনসংখ্যার হিসেবে শতকরা এক ভাগের মতো মানুষের প্রাইভেট কার আছে৷ কিন্তু সড়ক চলে গেছে তাদের দখলে৷
সরকারি গণপরিবহনের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি ৩৩ গুণ বেশি থাকলেও এ সব ব্যক্তিগত গাড়িতে মাত্র ১৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা হয়৷ বাস ৪৯ শতাংশ যাত্রীর দায়িত্ব নেয়৷
ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে এখনো রেলগাড়ি চলাচল করে৷ ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে রেল লাইন যাওয়ার ফলে ১৭টি পয়েন্টে রাস্তা বন্ধ করে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়৷ এ সব পয়েন্টে দিনে কমপক্ষে ১০ বার যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়৷
সরকারের পরিকল্পনা
এ সব সমস্যা সমাধানে সরকার ২০১৪-১৫ সালে একটি রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) অনুমোদন করে, যাতে পাঁচটি পাতাল রেললাইন, দু'টো দ্রুতগতির বাস রুট এবং ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷ আর তা বর্তমান সড়ক নেটওয়ার্কের দ্বিগুণ৷ এতে ছয়টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং তিনটি রিং রোড অন্তর্ভুক্ত আছে৷ আগামী ২০ বছরে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের মোট ব্যয় হবে প্রায় ৩ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা৷
খসড়া পরিবহন পরিকল্পনায় আরো ৩ লাখ ৬০ হাজার অতিরিক্ত গাড়ি রাস্তায় নামানোর কথা বলা হয়েছে, যা অনেক বেশি পরিমাণে জায়গা দখল করবে৷ এ সব গাড়ি শুধু পার্ক করার জন্যই ৩ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার জায়গার প্রয়োজন হবে, যা গুলশান এবং বনানী আবাসিক এলাকার মিলিত আয়তনের প্রায় সমান৷
পুলিশ কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা
ঢাকার এই পরিবহণ সমস্যা এবং যানজট নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে৷ গবেষকরা নানা মতামতও দিচ্ছেন৷ তবে ঢাকার এক পুলিশ কর্মকর্তা আবু ইউসুফ প্রায় দু'বছর ধরে ঢাকার একটি এলাকার পরিবহণ ব্যবস্থা এবং যানজট নিরসনের জন্য তাঁর নিজের উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে সফলতা পান৷ এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদনও প্রচার হয়েছে৷ তিনি ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ঢাকা উত্তর বিভাগে ট্রাফিক পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ তাঁকে তেজগাঁ শিল্প এলাকা, মগবাজার, রামপুরা
এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল৷ আর এই এলাকাগুলোতে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার সব কারণ বিদ্যমান৷ এখানে রেলক্রসিং, ফ্লাইওভার, যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহন, প্রাইভেট কারের আধিক্য সব কিছুই আছে৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকাসহ সব সমস্যা মেনে নিয়েও শুধুমাত্র নিয়ম মানার মধ্য দিয়ে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার অনেক উন্নতি সম্ভব৷ এখানে নিয়ম না মানার শীর্ষে প্রাইভেট কার৷ তারা ইচ্ছে মতো চলাচল করে৷ আমি ডানের গাড়ি ডানে, বামের গড়ি বামে – এই নীতি অবলম্বন করে আমার এলাকায় যানজট অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিলাম৷ তাছাড়া রাস্তায় ঘন ঘন ক্রসিং বন্ধ করেও সুফল পেয়েছি৷’’
পথচারীরাও যানজটের একটা প্রধান কারণ৷ তারা যদি আন্ডার পাস অথবা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন তাহলে যানবাহনের গতি বাড়ে৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি নিজে রাস্তায় নেমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করেছি৷ মানুষকে বুঝিয়েছি, প্রচারণা চালিয়েছি সচেতন করেছি৷ রিক্সার জন্য আলাদা লেন করেছি৷ কারণ যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন একই সড়কে চললে গতি কমতে বাধ্য৷’’
তাই ‘‘আমার বিবেচনায়, গাড়ি চলাচলে ডান-ডান, বাম-বাম নীতি না মানা, একই সড়কে যান্ত্রিক অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল, রাস্তায় নির্মাণ কাজ, খোড়াখুড়ি, রাস্তায় পার্কিং, ঘন ঘন ক্রসিং এবং ট্রফিক আইন অমান্য করা, উলটোপথে গাড়ি চালানো যানজটের প্রধান কারণ৷ এর সাথে আছে রাস্তার সমতা না থাকা৷ চওড়া সড়ক যখন সরু সড়কে গিয়ে মেশে তখন যানজট তো হবেই৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের এখন যা আছে তা দিয়েই আমি সমস্যার সমাধান খুঁজেছি৷ বর্তমান কাঠামোর মধ্যেই ট্রাফিক ব্যবস্থা আরো কীভাবে ভালো করা যায় আমি তার চেষ্টা করেছি৷ আর কাঠামোগত সংস্কারসহ আরো অনেক বিষয়ের কথা বলতে পারবেন বিশেষজ্ঞরা৷’’
বলা বাহুল্য, ঢাকার যে ট্রাফিক চিত্রের কথা বলা হলো, তা স্বাভাবিক পরিস্থিতি৷ কিন্তু জলাবদ্ধতা, বৃষ্টি বা বিশেষ পরিস্থিতিতে কী হতে পারে বা হয়, তা মনে হয় গবেষণায়ও বোঝা কঠিন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷