‘বিজয়’ দেখেছিলেন প্রিয়ভাষিণী
৬ মার্চ ২০১৮‘‘বিজয় দেখেছি আমি৷ যুদ্ধের নয়টি মাস যে কেমন ছিল সেটা আমি কখনোই ভুলতে পারি না৷ আমি বুঝতে পারি না যে যুদ্ধ হবে সেনাবাহিনীর সাথে সেনাবিহিনীর, কিন্তু এই সাধারণ বেসামরিক মানুষের উপর যে পাকিস্তানি বাহিনীর ন্যক্কারজনক আচরণ এবং আক্রমণ, সেটা কেন? চোখের সামনে নারকীয় দৃশ্য৷ এখানে-সেখানে মা-বোনদের ধর্ষণ৷ কখনো গণধর্ষণ৷ নির্যাতনের শিকার নারীদের আর্তচিৎকার৷ আলোহীন প্রকোষ্ঠে প্রতিনিয়ত কতগুলো অসহায় নারীর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া৷ হত্যাসহ সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া– এসব কিছুই দেখেছি আমি৷ এ যেন সভ্য পৃথিবীর বাইরের অন্য কোনো জগৎ৷'' কথাগুলো ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন একাত্তরে পাক সেনাদের নির্যাতনের শিকার ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী৷
১৯৪৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা শহরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী৷ তাঁর মা রওশন হাসিনা ও বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক৷ খুলনার পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইচএসসি ও পরে ডিগ্রি পাস করেন৷ ১৯৬৩ সালে খুলনার আগা খান স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন৷ পরে স্কুলের চাকরি ছেড়ে একটা পাট কারখানায় অভ্যর্থনা ডেস্কে কাজ নেন তিনি৷
১৯৭১ সালে তাঁর সাথে প্রথম স্বামীর বিচ্ছেদ হয়ে যায়৷ স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর যুদ্ধের সেই ভয়াবহতার মাঝে একা একজন নারী হয়েও তিনি সন্তানদের নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবছিলেন৷ আর ঠিক এরকম সময়ই তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়৷ ১৯৭১ সালে এদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়েদের মতো তিনিও পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন৷
ডয়চে ভেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের সময়পাকসেনাদের নৃশংস বর্বরতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রিয়ভাষিণী বলেন, ‘‘সংসারের বড় দায়িত্ব ছিল আমার উপর৷ তাই সেই দায়ভার সামলানোর জন্য একটি পাট কলে চাকুরিতে যোগ দিই৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জীবন বাঁচাতে শহর ছেড়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে ৭ই এপ্রিল প্রথম পাক বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করি৷ আমার চোখের সামনে প্রায় ১০০ গজের মধ্যে ১৪ জনকে হত্যা করে পাক সেনারা৷ আমিসহ আরো কয়েকজন যে বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম সেটির চারিদিক দিয়েও পাক বাহিনীর গাড়িও ঘুরে গেল৷ তবে তারা সেখানে আমাদের উপস্থিতি টের না পাওয়ায় সেই দফা আমরা রক্ষা পেয়ে যাই৷এরপর আর সেই বাড়ি থেকেও আমাদের পালিয়ে যেতে হলো৷ এ সময় তিনটি ছোট শিশুর ভার এসে পড়ে আমার উপর৷ অথচ সেসব শিশুদের খাওয়ানোর মতো পয়সা আমার কাছে ছিল না৷ একজন ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে এনে বাজার থেকে দুধ কিনে সেই শিশুদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি৷ এরপর দৌলতপুরের কাছে একটি মুরগি খামারের পাশের নির্মাণাধীন বাড়িতে আশ্রয় নিই আমি এবং আরো কয়েকটি পরিবার৷ তবে সেখানেও বেশি দিন থাকতে পারিনি আমরা৷ এছাড়া যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ায় সামাজিকভাবে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা ছিলনা৷ তাই উপায়ান্তর না দেখে আবারো আমি আগের পাট কারখানায় চাকুরিতে যোগ দিই৷ সেই চাকুরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি জুট মিলের মধ্যেই৷ সেই কারখানার কর্মকর্তাদের কাজ ছিল প্রতিদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ডেকে এনে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতো এবং আমাকে তাদের হাতে তুলে দিতো৷ এরপর ২৮ অক্টোবর আমাকে ধরে নিয়ে যায় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে৷ সেখানে আরো বেশ কিছু দিন অবরুদ্ধ থাকার পর অনেক অনুনয় বিনয় করে পাটকলের কোয়ার্টারে ফিরে আসি৷''
এরপরও রক্ষা পাননি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী৷ পাক বাহিনীর পরাজয়ের শেষ পর্যায়ে প্রিয়ভাষিণীকে হত্যা করার জন্য তাঁর বাড়িতে হানা দেয় পাক সেনারা৷ তবে সৌভাগ্যক্রমে কীভাবে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তা জানালেন এই সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ঠিক এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে ঘর থেকে আমি বের হয়েছিলাম বলেই রক্ষা পেয়েছিলাম সেদিন৷ আর আমার ঘরে আমাকে না পেয়ে অন্য যে লোক ছিল তাকেই সেখানে হত্যা করে পাক সেনারা৷''
১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছর প্রিয়ভাষিণী একজন গৃহবধূ হিসেবেই জীবনযাপন করেছেন৷ ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি একটানা কাজ করে গেছেন৷ টেলিফোন অপারেটর হিসেবে যেমন কারখানায় কাজ করেছেন, তেমনি ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, এফএও, ক্যানাডিয়ান দূতাবাস প্রভৃতি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছেন৷ শেষ বয়সে এসে নানা শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন এবং তা অবিরামভাবে অব্যাহত রেখেছেন৷
প্রিয়ভাষিণী যেভাবে ফেলে দেওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া কাঠের টুকরা, শিকড়, গাছের গুঁড়িকে তুলে এনে নতুন জীবন দিয়েছেন, তা অসাধারণ৷ এটা তাঁর নিজের জীবনের সাথে মিলে যায়৷ কারণ যুদ্ধের সময় তিনি পাক সেনাদের অত্যাচারে প্রায় ফুরিয়েই যেতে বসেছিলেন৷ কিন্তু সেখান থেকে তিনি আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন৷
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ২০১০ সালে ‘স্বাধীনতা দিবস' পদক লাভ করেন৷
হোসাইন আব্দুল হাই