সৌদি আরবের কাছে কেন জবাব চায় না সরকার?
২৯ নভেম্বর ২০১৯দীর্ঘ সাত বছর বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ রাখার পর ২০১৫ সালে সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা শুরু হয়৷ শেষদিকে এসে হয় চুক্তি৷ শর্ত ছিল বাংলাদেশ আগে গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন নারী শ্রমিক পাঠাবে, তবেই পুরুষদের জন্য দেশটির শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে৷ চুক্তির আগে-পরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এই বিষয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন করে খবরাখবর জানিয়েছে৷ সেই সময়ের মন্ত্রী আর সচিবকে গণমাধ্যমকর্মীরা বারবার নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন৷ মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল৷ কথা ছিল মোবাইলে সার্বক্ষণিক নারীদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকবে, দূতাবাস প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেবে ইত্যাদি৷
আসলে কতটা নিরাপত্তা তারা নিশ্চিত করেছেন তার নমুনাটা দেখা যাক৷ গত চার বছরে সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন আট হাজার নারী শ্রমিক৷ বলা বাহুল্য, তাদের অধিকাংশ ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ এক বুক স্বপ্ন নিয়ে যারা দেশ ছেড়েছিলেন, তারা বয়ে এনেছেন ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন আর মানসিক যাতনার স্মৃতি৷ ৬৬ জন ‘ভাগ্যবান' ফিরেছেন লাশ হয়ে৷ অথচ এই মানুষগুলো প্রত্যেকেই গিয়েছিলেন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্ন তাদেরকে সরকার বা রাষ্ট্রই দেখিয়েছে৷ দায়টা তাই তাদের মাথা পেতে নেয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু নিজের জনগণ অন্য দেশে গিয়ে নিগৃহীত হচ্ছেন, সেজন্য সামান্য বিব্রতও কি সরকার হয়েছে?
তাদের কাছে অবশ্য হত্যা বা নির্যাতনের চিত্রটা নিছক কিছু সংখ্যা৷ সেখানে রক্ত মাংসের শরীরের মানুষ নেই৷ তাদের কান্না, তাদের উপর নির্ভরশীল পরিবারের কোনো অস্তিত্ব নেই৷ সেকারণেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবলীলায় বলতে পারেন, ‘‘শতকরা হিসেবে সংখ্যাটা খুবই সামান্য৷ ৯৯ শতাংশ নারী ‘ম্যানেজ' করে নিয়েছেন৷'' একটি দেশের নাগরিক যখন অন্য দেশে যান, তাও আবার পাচার নয়, অবৈধভাবে নয়, দুই সরকারের মধ্যে করা চুক্তির অধীনে, তখন তার সমস্ত ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব সরকারের; বিশেষ করে সামনে থেকে ভূমিকাটি রাখার কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের৷ কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী যখন এমন কথা বলেন তখন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটি বুঝতে আর বাকি থাকে না৷কিন্তু সমস্যাটা কি শুধু দৃষ্টিভঙ্গিতে, নাকি সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের নতজানু কূটনৈতিক সম্পর্কও এর জন্য দায়ী?
একের পর এক নারী নির্যাতিত ও লাশ হয়ে ফেরার ঘটনায় সৌদি সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ, ব্যবস্থা নেয়ার দাবি কিংবা অন্ততপক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ব্যাখ্যা চাইতে পারতো সরকার৷ সেটা স্বাভাবিক কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ারই অংশ হতে পারতো৷ কিন্তু এমন কিছু ঘটেছে বলে আমরা শুনতে পাইনি৷ গত তিন বছরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার রাষ্ট্রীয় সফরে গেছেন দেশটিতে৷ সেখানে একটিবারের জন্য তিনি দেশটির বাদশাহ বা রাজপরিবারের কাছে কি এই প্রসঙ্গ তুলেছেন? যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যে গেলে প্রধানমন্ত্রী সেখানকার বাংলাদেশিদের সাথে দেখা করেন৷ সৌদি আরবের প্রবাসী শ্রমিকরা, তার দেশের নারী গৃহকর্মীরা বাড়ির অন্দরমহলে কেমন আছেন, তিনি কি কখনো তাদের কাছ থেকে জানার উদ্যোগ নিয়েছেন? এমন কোনো খবর আমরা পাইনি৷
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের প্রতিবাদ তো দূরে থাক, উল্টো সৌদি সরকারই হুমকি দিয়েছে সরকারকে৷ প্রথম আলোতে ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীদের নির্যাতনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় নাকি বিব্রত হয়েছে দেশটি৷ আর বাংলাদেশকেই সেগুলো সুষ্ঠুভাবে সমাধান করতে বলেছে তারা৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘তা না হলে নারী গৃহকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সৌদি কর্তৃপক্ষ একতরফাভাবে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে বলে বাংলাদেশকে বলে দিয়েছে৷'' চিন্তা করে দেখুন, যা ঘটছে তাতে ঠিক এই কথাগুলো বাংলাদেশের বলার কথা সৌদি আরবকে৷ কিন্তু দেশটি উল্টো বাংলাদেশকে ধমকাচ্ছে৷ আবার বাংলাদেশের যেখানে কড়া প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শতকরা হিসাবের অঙ্ক কষে ‘তেমন কিছুই ঘটছে না' মর্মে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন৷ কেন এত ভয় আর অনীহা সৌদি আরবের কাছে প্রতিবাদ জানাতে?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সৌদি আরব ছিল পাকিস্তানের পক্ষে৷ স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম এই শক্তি৷ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় দুই দেশের মধ্যে৷ এরপর একে একে ৪০ লাখ শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরবে৷ সেখান থেকে তারা বছরে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন দেশে৷ সবচেয়ে বড় এই শ্রমবাজার ধরে রাখতে সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার একটি চিন্তা সব সরকারেরই থাকে৷
কিন্তু এই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে গত কয়েক বছরে সরকার একটু বেশিই যেন হেলে পড়ছে দেশটির দিকে৷ চলতি বছরের মার্চে বিতর্কিত সামরিক চুক্তি করেছে, যার মধ্য দিয়ে বলতে গেলে ইয়েমেনে সৌদি আরবের আগ্রাসনকে এক ধরনের সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশ৷ বিনিময়ে সৌদি বাদশাহ ও প্রিন্সের পাঠানো মন্ত্রীরা এসে বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিয়োগ চুক্তি করেছে৷
সৌদি সরকার সম্প্রতি তার অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে৷ বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে তারা ভারত, পাকিস্তানে৷ যে দৌড়ে শামিল হয়েছে বাংলাদেশও৷ দেশটির শ্রমবাজার এবং এই বিনিয়োগ ধরতে গিয়ে শ্রমিক নিগ্রহের ঘটনাকে আর বড় করে দেখতে পারছে না সরকার৷ সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ে দেশটির রাজতন্ত্রকে খুশি রাখাও গুরুত্বপূর্ণ সরকারের কাছে৷ তারই বলি হচ্ছেন বাংলাদেশে নারী শ্রমিকরা?
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷