‘সৌদি বিনিয়োগকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই’
৮ মার্চ ২০১৯সৌদি আরবের বাণিজ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী ব্যবসায়ীদের একটা বড় দল নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন৷ হঠাৎ করেই সৌদি আরবের এই বিনিয়োগকে কেউ কেউ অন্য চোখেও দেখছেন৷ তাঁরা বলছেন, সৌদি সাংবাদিক খাশগজি হত্যাকাণ্ডের কারণে পশ্চিমা বিশ্বে কোণঠাসা সৌদি যুবরাজ এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মিত্র খুঁজছেন৷ সে কারণেই এসব বিনিয়োগ নিয়ে তিনি মাঠে নেমেছেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিষয়টা এমন নাও হতে পারে৷ কারণ খাশগজি হত্যাকাণ্ড খুব সাম্প্রতিক বিষয়৷ আর এই ধরনের বিনিয়োগ হঠাৎ করেই হয় না৷ এর জন্য সময় নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হয়৷ আমরা বিষয়টাকে ওভাবে না দেখে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই৷ কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক নতুন নয়, দীর্ঘদিনের৷ কখনও এই সম্পর্কের অবনতি হতে আমরা দেখিনি৷ বিশেষ করে বর্তমান সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো৷ প্রধানমন্ত্রী যখন সৌদি আরব যান এবং যুবরাজের সঙ্গে বৈঠক করেন তখন সময়টা কিন্তু খাশগজি হত্যাকাণ্ডের পরপরই৷ এ নিয়ে অনেকেই নানা কথাবার্তা বলেছেন৷ আসলে এই ধরনের বৈঠকের সূচি কিন্তু অনেক আগেই নির্ধারিত হয়৷ আর আমাদের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক সেখানে কাজ করছে৷ মাঝেমধ্যেই তারা নতুন করে শ্রমিক নিচ্ছে৷ ফলে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা রাখতেই হয়৷''
সৌদি বিনিয়োগে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কতটা? বর্তমানে দুই দেশের যে সম্পর্ক তাতে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হচ্ছে? জবাবে জনাব আহমেদ বলেন, ‘‘অবশ্যই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে৷ এখন নতুন বিনিয়োগের যে প্রস্তাব নিয়ে তারা এসেছে সেটা একেবারেই প্রাথমিক আলোচনা৷ এই আলোচনা কতদূর গড়ায় সেটা দেখতে হবে৷ তবে বিদেশি যে-কোনো বিনিয়োগকেই আপনি ইতিবাচক হিসেবে দেখতে পারেন৷''
সৌদি আরবের বাণিজ্য ও বিনিয়োগমন্ত্রী মাজেদ বিন আবদুল্লাহ আল কাসাবি, অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী মোহাম্মেদ বিন আলতোয়াজরির নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আসা প্রতিনিধি দলে দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সদস্যরা ছিলেন৷ বৃহস্পতিবার ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নিয়ে একাধিক সংলাপ হয়৷ পরে রাতেই তাঁরা চলে যান৷
বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, বড় বড় প্রকল্পে সৌদি আরবের কাছে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চেয়েছে বাংলাদেশ৷ সৌদি প্রতিনিধিদল প্রতিটি প্রকল্পের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন৷
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
এদিকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিষয়ে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করেছে বাংলাদেশ৷ রিয়াদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সমঝোতা স্মারকটি সই হয়৷ বাংলাদেশের পক্ষে এমওইউতে সই করেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজুর রহমান৷ সৌদি আরবের পক্ষে সই করেন দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ লেফটেনেন্ট জেনারেল মুতলাক বিন সালিম আল উজাইমিয়া৷
এমওইউ অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দু'টি ব্যাটালিয়নের প্রায় ১,৮০০ সদস্য ইয়েমেন সীমান্তে মাইন অপসারণ কাজে নিয়োজিত হবেন৷ এটা সই হওয়ার পরই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি ইয়েমেন যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে? এতে দেশের ভাবমূর্তি কোথায় দাঁড়াবে?
ওই দিনই সংসদে বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, ‘‘এই এমওইউ সই করার মধ্য দিয়ে আমাদের সংবিধানের ২৫ বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করা প্রয়োজন৷ দুই দিক দিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে৷ প্রথমটি হচ্ছে, এই সেনাবাহিনী মোতায়েন জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা? দ্বিতীয়ত, আমাদের সেনাবাহিনীর বিদেশে উপস্থিতিতে আমাদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তির কী হবে? আমরা জানি ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে যে সমঝোতা এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে সেখানে প্রতিমুহূর্তে আক্রমণ চালাচ্ছে ‘বিদ্রোহীদের' দমন করতে৷ আমরা জানি, আরব দেশের বসন্তের বিকৃত প্রয়োগ ঘটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে কী ধরনের পরিণতি সৃষ্টি করেছিল এবং সৌদি আরব সেখানে কোন সুবিধা নিতে যাচ্ছে?''
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই এমওইউ নিয়ে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে৷ আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আমাদের সেনা সদস্যরা কমব্যাট অপারেশনে যাচ্ছেন না৷ অর্থাৎ তারা যুদ্ধে জড়াবেন না৷ তারা শুধুমাত্র সীমান্ত এলাকায় মাইন অপসারণ করবেন৷ কারণ আমরা কুয়েতে এই কাজটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে করেছি৷ ফলে আমাদের যে ইউনিট যাচ্ছে তারা ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের৷ আমরা সেখানে যে কাজটি করব সেটা যতটা না সামরিক, তার চেয়ে বেশি মানবিক৷ কারণ এই মাইনগুলো অপারেশনে কতটা ক্ষতি করছে, তার চেয়েও ঝুঁকিতে ফেলছে সাধারণ মানুষকে৷''
রশীদ বলেন, ‘‘বরং এটা বলা যায়, ২০১৫ সালে যখন সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটে বাংলাদেশ যখন নাম লিখিয়েছিল সেটা ছিল ৩৪ জাতির সামরিক জোট৷ ওই জোট থেকে যুদ্ধে যাওয়ার বিষয় ছিল৷ কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, সেটা দুই দেশের সমঝোতা স্মারক৷ ফলে এখানে যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টি অমূলক৷''