সৌদিতে ‘কাফালা আইনে’ পরিবর্তনই কি যথেষ্ট?
৬ নভেম্বর ২০২০চাইলে দেশেও ফিরে যেতে পারবেন৷ এতে সৌদি আরবে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীরা কতটা উপকৃত হবেন?
কাফালা শব্দটি আরবি ‘কফিল' শব্দ থেকে এসেছে৷ কফিল মানে মালিক৷ কাফালা আইন অনুযায়ী, প্রবাসী কর্মীরা সেখানে একজন মালিকের অধীনে কাজ করতে যান৷ তার অনুমতি ছাড়া নতুন কোনো জায়গায় কাজ নেয়া বা দেশে ফেরা বেআইনি৷ এমনকি নির্যাতনের শিকার হলেও না৷ নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ পালিয়ে গেলে ওই কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়৷ কেউ মারা গেলে মালিকের অনুমতি ছাড়া দেশে লাশও পাঠানো যায়না৷
এই আইনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনসহ নানা মহল থেকে অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছিল৷ অবশেষে সৌদি আরবের জনশক্তি উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বিন নাসের আবুথুনাইন বুধবার রিয়াদে কাফালা নীতিতে পরিবর্তন আনার কথা জানিয়েছেন৷ আগামী মার্চ মাস থেকে তা কার্যকর হবে৷
সেটা হলে সৌদি আরবে প্রবাসী কর্মীরা মালিকের অনুমতি ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের কাজ বা চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন৷ মালিক কোনো বাধা দিতে পারবেন না৷ আর কেউ চাইলে দেশেও ফিরে যেতে পারবেন৷ সৌদি মন্ত্রী বলেন, ‘‘এর মাধ্যমে আমরা একটি আকর্ষণীয় শ্রমবাজার গড়ে তুলতে চাই, এখানে কাজের পরিবেশকে উন্নত করতে চাই৷''
আরো জানানো হয়েছে, প্রবাসী কর্মীরা মালিকের অনুমতি ছাড়াই সেখানকার সরকারি সেবার জন্য আবেদন করতে পারবেন৷ তারা স্বাধীনভাবে সৌদি আরবের ভিতরে ও বাইরে ভ্রমণ করতে পারবেন৷ তাদের নিয়োগের চুক্তি ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হবে৷
নতুন এই পদ্ধতি চালু হলে বাংলাদেশের কর্মীরাও সেখানে সুবিধা পাবেন বলে মনে করেন ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান৷ তবে আইনটি কার্যকর হওয়ার আগে আসলে বলা সম্ভব নয় যে কতটা সুবিধা প্রবাসী কর্মীরা পাবেন৷
সৌদি আরবে এখন বিভিন্ন দেশের প্রায় এক কোটি প্রবাসী কর্মী রয়েছেন৷ তার মধ্যে ২০ লাখ বৈধ বাংলাদেশি আছেন৷ আর বাংলাদেশিদের মধ্যে তিন লাখ নারী কর্মী, যারা গৃহকর্মী হিসেবে সেখানে কাজ করেন৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৪০ হাজার কর্মী যান সৌদি আরবে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০ হাজারের মতো বাংলাদেশি নাগরিক ডিপোর্টেশন সেন্টারে আছেন৷ তার অধিকাংশই সৌদি আরবে৷ ২০১৪ সালে আট লাখ বাংলাদেশি সেখানে সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছেন৷
শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘গৃহকর্মী হিসেবে যারা সৌদি আরবে কাজ করেন তারা ৯ ধরনের কাজ করেন মালিকের বাড়িতে৷ কাফালা পদ্ধতির পরিবর্তন হলে যে রাতারাতি তাদের অবস্থার উন্নতি হবে তা বলা যায়না৷ আগে তাদের পালিয়ে আসতে হতো৷ আর পালিয়ে আসার পর তাদের বিরুদ্ধে চুরির মামলা হতো৷ এখন হয়তো কেউ কাজ না করলে চলে আসতে পারবেন৷ কিন্তু নির্যাতন পরিস্থিতি বন্ধ করতে হলে আইনে আরো পরিবর্তন আনতে হবে৷ বাংলাদেশ সরকারকেও দায়িত্ব নিতে হবে৷ কারণ সেখানে থেকে মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়৷''
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের হিসাব মতে, গত চার বছরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৪৭৩ জন বাংলাদেশী প্রবাসী নারী কর্মী মারা গেছেন৷ এরমধ্যে সৌদি আরবে মারা গেছেন ১৭৫ জন৷ ৮১ জন নারী কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আত্মহত্যা করেছেন৷ তার মধ্যে সৌদি আরবে ৫১ জন৷ গত দুই বছরে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা ৬৩ জনকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ তাদের মধ্যে ৫৮ জনই নারী৷
শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলকে সামনে রেখে এরইমধ্যে তাদের কাফালা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে৷ তারও প্রভাব পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে৷ সৌদি আরব ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক দেশ এই পবির্তনে এগিয়ে আসছে৷ তবে একটি সংকটও সামনে আসতে পারে৷ কাতার ও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক দেশে প্রবাসীদের জন্য শ্রমবাজার সংকুচিত হতে পারে৷ বিশ্বের পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ওই দেশগুলো তাদের নিজেদের দেশের কর্মী বাড়াতে চাইছে৷’’
পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হলেও কাফালা বহাল থাকছে৷ কিন্তু অভিবাসন বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, নির্যাতন বন্ধ করতে হলে পুরো কাফালা পদ্ধতিই বাতিল করা প্রয়োজন৷ তা না হলে কর্মীদের একজন মালিকের অধীনেই যেতে হবে সেখানে৷ আর এই আইন পরিবর্তন হলে গৃহকর্মীরা সুযোগ পাবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ‘‘স্বাধীনভাবে কাজ পরিবর্তন বা দেশে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া একটা অগ্রগতি৷ কিন্তু সৌদি আরবে প্রবাসী কর্মীদের শ্রমঘণ্টা ও বেতনের কোনো আইন নেই৷ ফলে কফিল বা নিয়োগকারী তাকে তার ইচ্ছে মতো কাজ করায়, মজুরি দেয়, নির্যাতন করে৷ এটার জন্য শ্রম আইন সেখানে চালু হওয়া দরকার৷''
তিনি বলেন, ‘‘নির্যাতন হলে তার প্রতিকার, ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন৷ এজন্য বাংলাদেশ সরকারেরও সৌদি আরবের সাথে আলোচনা শুরু করা উচিত৷''
তার মতে, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অধীনে নিয়োগ হতে পারে, তবে তা সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে করার বিধান করতে হবে৷