সালটা ২০০৮৷ স্কুল পাস করে আমি তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী৷ কাঠফাটা রোদের এক দিনে এক সিনিয়র দাদা হঠাৎই মোবাইলে শোনালেন একটা গান৷ সাহানা বাজপেয়ীর কন্ঠে ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা'৷ ইলেক্ট্রিক গিটারের হালকা আমেজ, মূল গানের সাথে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা গুনগুন... কান পেতে শুনলে মনে হবে সকালে গলা সাধার সরগম, কিন্তু পেশাদার পরিভাষায় তার নাম ‘ব্যাকিং ভোকালস' বা সহযোগী কন্ঠ৷
আমার এত বছরের রবীন্দ্রসংগীত শোনার অভ্যেসের সব কিছু চুরমার হয়ে গেল৷ গানটি যে সংকলনে ছিল, ‘নতুন করে পাব বলে', সেই নামের মতোই একদম নতুন করেই প্রেমে পড়লাম রবীন্দ্রসংগীতের৷ হুট করে চেনা গান গুরুগম্ভীর পরিবেশ থেকে এক লাফে আমার কোলে, যেন সে এত দিন এভাবেই বেজে ওঠার অপেক্ষায় ছিল৷
সেদিন সেই অ্যালবামের সংগীত পরিচালক অর্ণব শায়ান চৌধুরী দেখিয়ে ছিলেন কীভাবে শিল্পকে স্বাধীন করে তোলা যায়৷ গানের মূল স্রষ্টার শৈল্পিক স্বাধীনতায় আঘাত না হেনেই৷ কিন্তু সেই অ্যালবামটি আমার পরিচিত অনেক সংগীত প্রেমী-অপ্রেমীদের মনে গাঁথলো না৷ তাদের ‘রাবিন্দ্রীক অনুভূতিতে' সেই সময় বেজায় ব্যথা লেগেছিল৷
রবীন্দ্রসংগীত যেখানে বাণীপ্রধান একটি শিল্প বলে পরিচিত, সেখানে কোন সাহসে গান শুরুর আগে আড়াই মিনিট ধরে এস্রাজ বাজে? এতটা মুক্ত, ‘বিচ্যুত' শিল্প কি সেই সমাজের সয়, যার অন্যতম পছন্দের শখ বা হবি সকল ফাঁকে দেবতা খোঁজা?
শিল্প যখন দেবতা, প্রশ্নাতীত
সময়ের ধারার বাইরে গিয়েস্বাধীন, মুক্ত থাকা সব শিল্পের দ্বারা হয়না৷ বিশেষ করে সেই শিল্পের স্বাধীন হওয়া হয়না, যার স্রষ্টা বা সেই গোটা জঁরার সাথেই (genre) একটা দেবত্ব এঁটে দেওয়া হয়েছে৷ যেমনটা হয় রবীন্দ্রসংগীত বা শাস্ত্রীয় সংগীতের ক্ষেত্রে৷ একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই৷
কর্ণাটক ধাঁচের শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করেন কন্ঠশিল্পী টি এম কৃষ্ণ৷ তার গায়ন, বাণী ও সুরের সমণ্বয় ও ব্যাখ্যা আর পাঁচজন সংগীত শিল্পীর থেকে আলাদা করে৷ সাথে, এই ধরনের গান বিষয়ে নানা ধরনের গবেষণাভিত্তিক ও ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি নানা পত্রপত্রিকায়৷
বাধ সাধলো যখন তিনি প্রশ্ন তোলেন দক্ষিণ ভারতে শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা, চর্চা ও শ্রবণের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা জাতিবিদ্বেষ নিয়ে৷ টি এম কৃষ্ণ নির্দ্বিধায় ‘আল্লাহ তেরো নাম' থেকে ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা' হয়ে দেশ রাগের বন্দিশে যাতায়াত করেন৷ গানের ফাঁকে ফাঁকে বলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের জগতে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যের কথা, বলেন যে আজও এই জগতে অনেকটাই ব্রাত্য দলিতরা৷
তাতেই লাগে ‘শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুভূতিতে' আঘাত৷ টি এম কৃষ্ণর কাছ থেকে একটি অত্যন্ত সম্মানীয় পুরষ্কার কেড়ে নেবার দাবিতে খোলা চিঠিতে সই করেন একশরও বেশি শিল্পী৷ কারণ, দেবতুল্য শাস্ত্রীয় সংগীত তো ততোটাও স্বাধীন নয় যে তাকে প্রশ্ন করা যায় বা অন্য শিল্পের পাশে বসিয়ে মাপা যায়৷
আমরা এটা ভাবিনা যে, টি এম কৃষ্ণের গলা দিয়ে বেরোনো সুরই কি শুধু তার শিল্প? রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীটুকুই তাই? তার প্রতিবেশ, প্রেক্ষাপট, প্রসঙ্গ বা সময়ের সাথে সাথে নতুন প্রাসঙ্গিকতায় সেই শিল্পের খোঁজও কি আসলে শৈল্পিকতা নয়? নাকি সেটা শুধুই ব্যাখ্যার রাজনীতি?
পরাধীন শিল্প দেখতে কেমন
শিল্প যেহেতু একটি সংস্কৃতির কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তের টুকরো প্রতিফলন, ফলে তার বিবেচনা করলে তা করতে হবে প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে৷ বর্তমান সময়ে শিল্পের স্বাধীনতা আলোচিত হচ্ছে কারণ এক সময় যে শিল্প বিবেচিত হতো আরাধ্য, উপভোগ্য, মর্মস্পর্শী হিসাবে, সেই একই গান, একই চিত্রশিল্প আজ পরিবেশিত হচ্ছে ভিন্ন নির্বাচনের রাজনৈতিক আঙ্গিকে৷
পাকিস্তানের কবি ফৈয়াজ আহমেদ ফৈয়াজের দুঃখের কথা বলি৷ ফৈয়াজ তার বিখ্যাত নজম ‘হাম দেখেঙ্গে' লিখেছিলেন ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হকবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে৷ তার কিছু বছর পর, পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয় ফৈয়াজের কবিতা, গান৷ নিষেধাজ্ঞার মাঝে কালো শাড়ি পরিহিতা ইকবাল বানো ১৯৮৬ সালে লাহোরের একটি সমাবেশে এই গানটি পরিবেশন করেন৷ ইউটিউবে খুঁজলে আজও পাওয়া যাবে বানোর কন্ঠের সেই গান, শোনা যাবে দর্শকাসন থেকে উচ্চারিত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগান৷
বহু হাত ঘুরে সেই গান সবচেয়ে সম্প্রতি শোনা গেছে ২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস' ছবিতে৷ একই পরিচালকের আরেকটি ছবিতে শোনা গেছে বিখ্যাত কবি হাবিব জালিবের ‘ম্যায় নাহি মানতা' কবিতাটিও৷ এই দুই ক্ষেত্রেই তথাকথিত বামপন্থি শিবির থেকে উঠে আসা, স্বৈরাচারবিরোধী আবেগে রচিত গানগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে ইতিহাসকে বিকৃত করা, বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা প্রেক্ষাপটে৷ চেষ্টা করা হচ্ছে শিল্পের মূল ভিত্তিকে ভুলিয়ে দেবার৷ কেন?
কারণ, লালনের গানের বাণী ফৈয়াজের গানের মতো আগেও মানুষকে চটাতো, এখনো চটাচ্ছে৷ তবে এখন রয়েছে বাড়তি সুবিধা৷ যে কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্যকে মুহূর্তে ভাইরাল করে একটি শিল্পের গোটা প্রেক্ষাপট, তার কাঠামো, বিন্যাস ও চর্চা সব কিছু এক ঝটকায় নস্যাৎ করে ফেলা যায় আজকের দিনে৷
আর বর্তমান সময়ে পরাধীন শিল্পের বাজার এতটাই বিস্তৃত, আধুনিক ও জনতুষ্টিমূলক – সমাজের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলির মতোই – যে সময় বুঝে এই বাজারই পালটে ফেলবে শিল্পের প্রসঙ্গ, ইতিহাস, উদ্দেশ্য৷ কবে দেখবেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়' গানকে মেলানো হচ্ছে কোনো আধিপত্যবাদের কাজে লাগাতে৷
তাহলে স্বাধীন থাকতে পারছেন কি ফৈয়াজ, জালিব, রবীন্দ্রনাথ বা লালন তাদের শিল্পের মধ্য দিয়ে? হয়তো হ্যাঁ, পারছেন, কিছু বিশেষ বিশেষ পরিসরে৷ তবে যখনই মগজধোলাই করতে শিল্প ব্যবহৃত হবে, তখন সে আর যাই হোক, নিজে স্বাধীন থাকবে না৷